Coronavirus

অসময়ের এই সব দিন-রাত, কমে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে কথা বলার সময় 

চেনা দোকান, চেনা মানুষ, চেনা পথঘাট, চেনা দুঃখ, চেনা সুখ। কিন্তু কিছুই আর স্বাভাবিক নয়। থমকে গিয়েছে সব কিছু। কখনও দু’একদিন যাতায়াতের পথে নজর এড়িয়ে গেলেও প্রায় জবাবদিহি করতে হয়েছে— ছিলাম তো! না, না! যাইনি কোথাও!

Advertisement

রবিশঙ্কর দত্ত

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২০ ০৭:২৭
Share:

কত দিনের পরিচিত এই দোকান। রাস্তা থেকে সিমেন্টের চার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়।

Advertisement

কত বছর ধরে চিনি দোকানিকে, তাঁর পরিবারকে। ওঁর স্ত্রী-ছেলে সবাইকে চিনি। বিস্কুট নেব, নুডল নেব, ব্যাটারি নেব। যেমন বছরের পর বছর নিয়েছি।

তার ফাঁকে বিস্কুট, কেনাকাটা বা দোকানের বাইরের কত রকম কথা বলেছি। পাড়া, পাশের পাড়া, বেপাড়া এমনকি, এ তল্লাটের কত বিষয় নিয়েই মত দিয়েছি, শুনেছিও।

Advertisement

কখনও দু’একদিন যাতায়াতের পথে নজর এড়িয়ে গেলেও প্রায় জবাবদিহি করতে হয়েছে— ছিলাম তো! না, না! যাইনি কোথাও!

এখন সে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই এক মাস যাচ্ছিই কম, কথাই বলছি না। শুধু কাজটুকু সেরে আচমকাই পিছন ফিরছি। দোকান ছেড়ে বাড়ি আসছি।

এই লকডাউন যেমন একেবারে নতুন, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাকি সব কিছুও নতুন। এই নতুনের সঙ্গে পরিচয়ের সময় যা কিছু সামনে আসছে, পিছনে চলে যাচ্ছে বা সঙ্গী হতে শুরু করেছে— সে সবই নতুন।

মুখে মাস্ক বাঁধা সকলের। চেনা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও অভিব্যক্তি বুঝতে সময় লেগে যাচ্ছে। প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষার সময় নেই। বিপদের তাড়া। বিপদ এড়ানোর তাড়নাও। তাই এই নতুন পর্বে কথা বলা কমে এসেছে সকলের।

বুদ্ধের সঙ্গে দেখা হলেই হাসত। রিকশার প্যাডেল ঠেলা থামিয়ে দেখামাত্র ওর একটাই জিজ্ঞাস্য ছিল— ‘দাদা, ভাল তো?’

জবাব দিয়েছি— ভাল রে ভাই। বুদ্ধর মতো এ পাড়ায়, বাজারে যাঁরা রিকশা চালাতেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই এই রকম কথা আমার অভ্যাস। অপ্রয়োজনীয় অথচ প্রিয় সেই সব কথা। দীর্ঘদিন প্রায় কারও সঙ্গেই দেখা নেই। তাই কথা হয়নি। বুদ্ধকেই দেখলাম সে দিন রাস্তার ধারে। তাকাতেই দু’হাত নেড়ে বলে উঠল— ‘লকডাউন!’ স্বভাবমতো হেসে উঠলেও সে হাসি কেমন যেন কম-কম। সাজানো হাসিতে নিজের অবস্থাই বোঝালো বলে মনে হল।

নিজে রিকশায় খুব কমই চড়েছি। তবে যা দু’একবার ওর সঙ্গে যাওয়া-আসার সুযোগ হয়েছে, অনেক গল্প করেছি। অনেক কথা শুনেছি বুদ্ধের মুখে। এ পাড়া কী ভাবে বদলে গিয়েছে, কেমন করে ওর শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখার সময় বড় বড় বাড়ি হয়েছে ওদের এই পাড়া জুড়ে, কোন পথে ওদের বৃষ্টিভেজার রাস্তায় গাড়ি উঠেছে— এই সব।

পাড়ার টালিঘরের গলি আমার খুব কাছের। সব বাড়ির মাথাতেই টালির মাঝে কাচ বসানো। টালির চালের মাঝে টালির বদলে টালিরই মাপে কাচ বসানো। অন্ধকার ঘুপচি ঘরে দিনের আলো ঢোকাতে এই ব্যবস্থা। আলোর খরচ এড়ানো যায়। বিকেলের দিকে সেই ঘর থেকে ভেসে এসেছে কিশোর-আশার ডুয়েট। টালি-বেড়ার সংসারেই মহম্মদ রফির গলায় শুনেছি— ‘ঝিলমিল সিতারোঁ কা অঙ্গন হোগা...’!

সন্ধ্যায় এই গলিতেই শুনেছিলাম, মা বা মায়ের মতো কারও মুখে শুনে শুনে কবিতা বলছে শিশু। ধুনোর গন্ধ, শাঁখের আওয়াজ ছাপিয়ে মন-মাথা ভরে গিয়েছে সে সবে। একটু রাত হয়ে গেলে কড়াইয়ে গরম তেলে ভাজা-পোড়ার আওয়াজ। গন্ধও।

লকডাউন চলাকালীন সেই গলি নিস্তব্ধ। টালি-বেড়ার ফাঁক গলে বাল্বের আলো এসে পড়েছে নিশ্চুপ গলিতে। গান নেই, পড়া নেই, কথা নেই। সেই ফ্যাকাসে আলোর নড়াচড়া দেখে বুঝলাম, তবে লোক আছে।

লকডাউনের শুরুতেই আলাপ হয়েছিল বাগদা সীমান্তে। বাংলাদেশের যশোর লাগোয়া এ-পারের বয়রার বাসিন্দা তাহের হাসান মণ্ডলের সঙ্গে। ওঁর আত্মীয় পুলিশে চাকরি করেন। কলকাতায় থাকেন।

তাহেরই একদিন ফোনে বললেন— ‘কাঁটাতারের ওপারে আমাদের জীবন পড়ে আছে!’

প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। কথায় কথায় বুঝলাম, কাঁটাতারের ওপারে নিজেদের জমিতে লাগানো পাকা ধানের কথা বলছেন। এখন যাতায়াত আগের মতো সহজ নেই। রক্ষীবাহিনী সময় বেঁধে দিয়েছে। সংখ্যা বেঁধে দিয়েছে।

পরপর ফোন করে অজানা অচেনা তাহের আর তাঁর প্রতিবেশীরা সে দিন বলছিলেন— ‘এখন তো জল সিঁচতে হবে গো! কী হবে আল্লাই জানেন!’

অ্যান্ড্রয়েড ফোনে সবুজ গাছে সোনার মুকুট পড়া সেই ধানিজমির ছবি পাঠিয়েছিলেন কৃষক পরিবারের ঝকঝকে তরুণ। দিনকয়েক পরে সেই তাহেরকে একবার ফোন করেছিলাম। কথা হল। কেমন আছেন? তাহের বললেন, ‘আমরা এক রকম আছি, দাদা! নিয়ম মেনে আছি। আল্লাকে ডাকছি, সব দুর্যোগ যেন কেটে যায়!

বেঁচে থাকলে ধান আরও হবে!’ ক’বস্তা চাল কিনে পঞ্চায়েতকে দিয়েছেন ওঁরা। অনেকে যে খেতেই পাচ্ছেন না!

বললেন, ‘এই দুর্যোগ কেটে গেলে একবার আমাদের গ্রামে আসবেন, দাদা!’

পথে মেসোমশাইয়ের চোখে চোখ পড়লে দাঁড়িয়েছি সব সময়। বাজার, নাতি-নাতনির স্কুল, রাজনীতি— আরও কত কথা। কী ভাবে এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা বদলে গিয়েছে, কী ভাবে একটা গ্রামীণ জীবন ধীরে ধীরে চূড়ান্ত গতিতে এগিয়ে চলা শহুরে মোড়কে জায়গা করে নিয়েছে— কত বার সে সব কথা শুনেছি, তার ঠিক নেই। এই পাড়ার নতুন বাসিন্দা হিসেবে প্রাইমারি স্কুলের লাগোয়া মন্দিরে দুর্গাপুজোর সপ্তমী, অষ্টমীতে বসে তাঁর কাছে শুনেছি, কী ভাবে এই পুজোর শুরু। কী ভাবে তা এগিয়েছে, বদলেছে।

সকাল সকাল স্নান সেরে বহুদিন বসে থাকতে দেখেছি ঠিক এই জায়গায়। হয় বাজার সেরে এসেছেন, নয়তো যাবেন। সেই চেহারায় এখন একটা শুকনো ভাব। বললেন— ‘এ সব আর কতদিন বন্ধ থাকবে, বাবা?’

নির্দিষ্ট করে তো জানা নেই কারও! তাও বললাম— আর ক’টা দিন কষ্ট করতে হবে, মেসোমশাই! ঠোঁঠ চেপে মাথা নাড়লেন প্রৌঢ়। তারপর বললেন—‘সবই বুঝতে পারছি। আমাদের জন্যই তো আমাদের ঘরে থাকতে বলছে। কিন্তু ঘরে আমার পাঁচটা পেট! বুঝে দ্যাখো, দিন-রাত মিলিয়ে দশ!’

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন