Coronavirus

ব্রিটেন যে ভাবে যুদ্ধে হারছে

এক দশকের বিনিয়োগহীন দেউলিয়া ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ভার লাঘব করার জন্যে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সব অসুস্থ লোককে পরীক্ষা না করার।

Advertisement

সুপ্রিয় চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২০ ০১:৪৮
Share:

কলকাতা লন্ডন হতে চায় না আর। বিলেত-ফেরত রোগীর ধাক্কায় ঔপনিবেশিক হাড়মজ্জায় হঠাৎ ভাইরাস ধরেছে। সময়ের নিরাপদ দূরত্ব থেকে ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা আমাদের এই ক্রমশ-প্রকাশ্য বিপর্যয়কে এক ঘুমে-হাঁটার উপাখ্যান হিসেবে দেখবেন। বন্যজন্তু খাওয়ার নিতান্ত চৈনিক অভ্যাস বাদুড়-রোগকে মানুষ-দেহে আনার পরেও চিন সরকার কয়েক মাস প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল ব্যাপারটা চাপা দিতে। কিন্তু তার পরেও, যখন এই অত্যন্ত সংক্রামক ব্যাধিটি অনেক দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েক দিন অপেক্ষা করল এই রোগকে মহামারি বলে ঘোষণা করতে। এবং তার পরেও, ব্রিটেন, সুইৎজ়ারল্যান্ড ও আমেরিকার মতো দেশ এই সংক্রমণ রুখতে এক খোলা-বাজারি নীতি নিল। ঠিক যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, বা ১৯২৯-এর মহামন্দায়, বা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটে একটু একটু করে, এক জন এক জন করে, বিশ্ব বিপর্যয় তৈরি হয়েছিল, এ যেন তার পুনরাবৃত্তি।

Advertisement

ব্রিটিশ সংবাদপত্রকে বিশ্বাস করলে, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ভাইরাস মোকাবিলা নীতির প্রথম আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংস-এর বক্তব্য ছিল, কিছু বুড়ো লোককে মরতে দিলে বিশেষ কিছু ক্ষতি নেই (১০ ডাউনিং স্ট্রিট অবশ্য এটা অস্বীকার করেছে)। এক দশকের বিনিয়োগহীন দেউলিয়া ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ভার লাঘব করার জন্যে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সব অসুস্থ লোককে পরীক্ষা না করার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘পরীক্ষা-পরীক্ষা-পরীক্ষা’ উপদেশ সত্ত্বেও ব্রিটেনে অসুস্থ হলে চোদ্দো দিন ঘরবন্দি থাকতে বলা হয়, পরীক্ষা ছাড়াই। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে দেন, অনেককেই তাঁদের প্রিয়জনকে হারাতে হবে এই রোগের কাছে।

এই সময়ে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, কোনও কারফিউ জারি করা হবে না। বরং, সরকারি নীতি ছিল ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বা ‘গোষ্ঠী প্রতিরোধক্ষমতা’ তৈরি করা, যাতে অনেক লোকের মধ্যে মৃদু সংক্রমণ ছড়িয়ে শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলা যায়। এ এক অত্যন্ত ব্রিটিশ মানসিকতা— বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলে রোগ-প্রতিরোধের চেষ্টা! এই নতুন করোনাভাইরাসের সামনে, যখন ইতালিতে হাজার হাজার লোক আক্রান্ত এবং সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভাঙনের মুখে, সরকারি ব্রিটিশ নীতি ছিল শিশুদের চিকেন পক্স পার্টির মতো: সংক্রমণ ছড়াবে তো ছড়াক। তাই, বিশ্বজোড়া মহামারির মধ্যে ব্রিটেনের স্কুল ২০ মার্চ পর্যন্ত খোলা ছিল, যদিও ছেলেমেয়েরা তার অনেক আগেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।

Advertisement

এই রাস্তায় চলার সমস্যা হল, করোনাভাইরাস সাধারণ ফ্লু-র চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক— প্রায় চার গুণ লোক এতে মারা যায়। শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা কী ভাবে এর মোকাবিলা করবে, আমাদের জানা নেই। এও জানি না যে এক বার এই সংক্রমণ হলে সেটা আবার ফিরে আসতে পারে কি না। কিন্তু অফিস-কাছারি, শেয়ার বাজার না বন্ধ করে ভাইরাসের এই খোলা-বাজারি মোকাবিলা করাটা সরকারের কাছে বড় আকর্ষণীয় লেগেছিল। ব্রেক্সিটের মতোই আর একটা অজানায় খোলা-বাজারের দোহাই দিয়ে চোখ বুজে ঝাঁপ দেওয়ার প্রলোভন সামলাতে পারেনি তারা।

এই হিসেবটা একটা বড় ধাক্কা খায়। ইম্পিরিয়াল কলেজের মডেল দেখায় যে ওই রাস্তায় চললে ব্রিটেনে পাঁচ লক্ষ লোক মারা যাবে। এক বার সংক্রমণ ছড়াতে দিলে আর কিছুই করার থাকবে না, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং অর্থনৈতিক দুর্গতি অসীম হবে। ।

এর পর থেকেই সরকারের সুর-বদল শুরু, যদিও তত ক্ষণে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহে রাশ টেনে সব কিছু বন্ধ করা সত্ত্বেও সংক্রমণ এবং মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। অপ্রস্তুতির পরিণামে যথেষ্ট পরীক্ষাও করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রাথমিক রাশছাড়া নীতির কারণে ব্রিটেনের যুবরাজ চার্লস, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক এবং ডমিনিক কামিংস করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। বিশাল আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার এখনও স্থির করে উঠতে পারেনি যে ছোট ব্যবসাগুলোকে কী ভাবে সাহায্য করা যায়— তার ফলে প্রায় ৮০,০০০ ব্যবসা বন্ধ হবার পথে । আর, ব্রিটেনের ভাইরাসের দূত দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

এই বিপর্যয়ে নতুন যদি কিছু শেখার থাকে তবে তা হল— পুরনো ভাবনায় নতুন সমস্যার সমাধান করা যায় না। ব্রিটেনে একটা প্রবাদ প্রসিদ্ধ, ‘ওয়াটারলুর যুদ্ধ আসলে ইটন স্কুলের খেলার মাঠে জেতা হয়ে গিয়েছিল’। অর্থাৎ ইটন স্কুলের শিক্ষা থেকে এমন সৈন্য তৈরি হয়েছিল যারা সহজেই যুদ্ধ জিততে পারে। তবে এই প্রবাদের আরও একটা অংশ আছে, যা অতটা জানা নয়: ‘কিন্তু পরের সব যুদ্ধের প্রথম লড়াইটা সেখানেই হারা হয়েছে’। অর্থাৎ পুরনো প্রথাগত ভাবনা দিয়ে এর পর আর লড়াই-এর মাঠে সুবিধে হয়নি।

বলা যেতে পারে, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রথম রাউন্ডও ইটন মাঠে হেরেছে ব্রিটেন। এ বার দেখার, হারকে জিত বানানোর ব্রিটিশ অভ্যেস বজায় থাকবে কি না।

কিন্তু ব্রিটেনে যাই হোক, অন্যদের এই ভুলগুলোর মাশুল দিতেই হবে, যেমন গত তিনশো বছর ধরে হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন