আপনার অভিমত
Coronavirus

যাঁরা চোখ থাকতেও অন্ধ, তাঁদের পরিস্থিতিটা বোঝান

জরুরি পরিষেবা বজায় থাকবে। বেশ কিছু দিন আগে থেকে ডাক্তারদের ছুটি বাতিলের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। এ সবই কিন্তু সংক্রমণ আটকানোর জন্য। ছুটির মেজাজে সবাই মিলে আড্ডা মারার জন্য নয়। লিখছেন চিকিৎসক অনির্বাণ জানা আগের দিন আড্ডাবাজ বন্ধুদের তুমুল আড্ডা চলছিল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। এখন তো ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আড্ডা নিজেকে বদলে নিয়েছে করোনার মতোই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২০ ০৩:০৩
Share:

জনতা কার্ফুর দিন মাঠে বসেছে আসর। রানাঘাটে। ছবি: প্রণব দেবনাথ

প্রথম কলবুকটা এল সাড়ে আটটার কাছাকাছি সময়ে।

Advertisement

আগের দিন আড্ডাবাজ বন্ধুদের তুমুল আড্ডা চলছিল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। এখন তো ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আড্ডা নিজেকে বদলে নিয়েছে করোনার মতোই। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, কনফারেন্স কল, স্কাইপে— ইত্যাদি মাধ্যমে চলছিল আড্ডা। শুধু মুহুর্মুহু চা আর ঠোঁট বদলের সিগারেটটাই যা নেই। সত্যি, মিথ্যে তথ্য আদানপ্রদান আর সেটা নিয়ে কাটাছেঁড়া, পরস্পরের পিছনে লাগা ইত্যাদি চলার সময়ে বন্ধুদের জানালাম জনতা কার্ফুর দিন রবিবার আমার ডিউটি আছে।

খ্যাঁক করে উঠলেন আমার ইএনটি স্পেশ্যালিস্ট বন্ধু— ‘‘লটারির টিকিট কাট নয়তো কৌন বনেগা ক্রোড়পতিতে নেমে যা। অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারদের রেস্টরুমে সারা দিন ঘুমিয়ে কাটাবি। উপরি পাওনা— বউয়ের খ্যাঁচখ্যাঁচ শুনতে হবে না।’’

Advertisement

মনে মনে তাই ভেবেছিলাম। অ্যাক্সিডেন্ট আর দাঙ্গাহাঙ্গামার চান্স শূন্য। সার্জারি ডিপার্টমেন্টে আসবে হয় তুমুল পেটব্যথা— সে অ্যাপেন্ডিক্স বার্স্ট করে হোক, নাড়ি ফুটো হয়ে বা হার্নিয়া আটকে গিয়ে। খুব বেশি হলে কিডনি স্টোনের ব্যথা নিয়ে। দু’এক জন পোড়া রোগী আসতে পারে। ছোটখাটো সমস্যার জন্য একটা জাতির স্বার্থে মানুষ বেরোবে না। তাই সিস্টারের ফোন পেয়ে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছিলাম যে রোগীর সমস্যা কী। সিস্টার ঝাঁজিয়ে উত্তর দেন— ‘‘কী আর হবে, অ্যাক্সিডেন্ট করে ঢুকেছে।’’

বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথম নজরে এল এক ভদ্রলোক জলঙ্গি থেকে স্নান করে ফিরছেন। তাঁকে বললাম—‘‘বাড়িতেই তো স্নানটা সারতে পারতেন আজকে।’’ প্রশ্নের জবাবে ইতস্তত করে বললেন, ‘‘বাড়িতে ঠাকুরকে জল দিতে হয় তো। নদীতে স্নান না করলে শুদ্ধ হয় না যে!’’

কিছু দোকান এ দিক ও দিক খোলা আছে। কিছু বেপরোয়া বাইক এঁকেবেঁকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। তবু তার মধ্যে কিছুটা সুনসান রাস্তাঘাট। অধিকাংশ দোকানই বন্ধ। স্টেশনের সামনে দেখলাম বেশ ভিড়। বড়সড় ব্যাগ নিয়ে বেশ কয়েক জন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ যাবেন তেহট্ট বা কেউ করিমপুর। ‘‘কোথা থেকে আসছেন ভাই?’’— আমার প্রশ্ন শুনে একটা ষণ্ডামার্কা ছেলে এগিয়ে এসে বলল— ‘‘আপনার নাক গলানোর কী দরকার আছে জানতে পারি?’’

দরকারটা শুধু আমার নয়। আমাদের রাজ্যের, আমাদের দেশের। সমগ্র মানবজাতির দরকার। আমরা যে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছি, ভাই। এটা কবে বুঝবেন আপনারা?

হাসপাতালে এক জন বললেন, ব্রাহ্মউপাসনার হেরিটেজ বিল্ডিংটার উল্টোদিকের মাঠে ক্রিকেট খেলা চলছে। প্রায় আর পাঁচটা বন্‌ধের মতো মেজাজ কিছুটা। কয়েক জন নিয়ম ভাঙছে আর তার জন্য মুখ থুবড়ে পড়তে পারে স্বাস্থ্য পরিষেবার ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা।

হ্যাঁ, পরিকল্পনাগুলোর মূল লক্ষ্য ভারত যেন প্যানডেমিকের পরের পর্যায়ে না পৌঁছে যায়। আমাদের দেশ এখন আছে দ্বিতীয় পর্যায়ে। গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হলে পৌঁছে যাবে তৃতীয় পর্যায়ে। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, আমাদের দেশের যে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো রয়েছে তাতে সেই পরিস্থিতি সামলানো প্রায় অসম্ভব। মৃত্যুমিছিল দেখবে আমাদের দেশ। তৃতীয় পর্যায় তখনই হয় যখন আক্রান্ত কোন সোর্স থেকে সংক্রামিত হল, বোঝা যায় না। এর মধ্যেই কিন্তু পুণে আর চেন্নাইয়ে এ রকম দু’জন আক্রান্তের খোঁজ মিলেছে। অতএব, সাধু সাবধান।

সর্বশক্তি নিয়ে নেমে পড়েছে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারও। আন্তর্জাতিক বিমান ওঠানামার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেন্দ্র। চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্যগুলোর সীমানা বন্ধ করার। শুরু থেকেই কিন্তু আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রশংসনীয় ভাবে করোনা মহামারি রোখার কাজ শুরু করছেন। লাল, নীল, সবুজ, গেরুয়া রঙগুলো আর সে ভাবে আলাদা করে পাত্তাও পাচ্ছে না।

লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছিল পৌর শহরগুলোয়। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি শহর সোমবার বিকেল থেকে বন্ধ করে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী ক্ষেত্রে গোটা রাজ্যকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত লকডাউন করার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য প্রশাসন। জরুরি পরিষেবা বজায় থাকবে। হাসপাতাল তো খোলা থাকবেই। বেশ কিছু দিন আগে থেকে ডাক্তারদের ছুটি বাতিলের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে।

এ সব কিন্তু সংক্রমণ আটকানোর জন্য। ছুটির মেজাজে সবাই মিলে আড্ডা মারার জন্য নয়।

অনুরোধ, হাসপাতাল খোলা আছে বলে বিনা কারণে বা অল্প কারণে হাসপাতালে বা ডাক্তারদের চেম্বারে ভিড় জমাবেন না। জায়গাগুলো পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত নয়। বিভিন্ন ধরনের রোগী অনবরত আসছে সেখানে। ফলে, সেখান থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা বেশ বেশি। খুব প্রয়োজন ছাড়া এড়িয়ে চলুন প্ল্যানড অপারেশনও। আর সব চেয়ে জরুরি কথা— গুজব ছড়াবেন না। যাঁরা চোখ থাকতেও অন্ধ তাঁদের পরিস্থিতি বোঝান।

‘‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ….’’ যাঁদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি, তাদের হৃদয়কে শকুন ও শেয়ালের খাদ্য হতে দেবেন না দয়া করে।

শল্যচিকিৎসক, শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল, নদিয়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন