আমাদেরও কিছু করার আছে
Coronavirus in West Bengal

পরিষেবায় গলদ থাকলে দায় সরকারের ঘাড়ে পড়বেই

করোনা-সঙ্কটে হাসপাতাল-নির্ভরতা এখন এক বেনজির পর্যায়ে পৌঁছেছে। আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলির উপর চাপ যেমন কয়েক গুণ বেড়েছে, তেমনই লোকের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়েছে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২০ ০০:০১
Share:

করোনা-যুদ্ধে আমাদের দায়িত্ব আমরা ঠিকঠাক পালন করছি তো?

আক্রান্ত বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। লকডাউনের এই পর্যায়ে এসে রাজ্যের করোনা-পরিস্থিতি যথেষ্ট অস্থির। যদিও সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছেন প্রচুর রোগী। সংশ্লিষ্ট সকল চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম এ ক্ষেত্রে আশার আলো দেখাচ্ছে। এঁদের সকলকে অজস্র অভিনন্দন। তবে এরই পাশাপাশি নতুন নতুন এলাকায় সংক্রমণও থেমে নেই। ফলে উদ্বেগের নিরসন সহজে হচ্ছে না। এতে প্রশাসন চিন্তিত। জনগণ শঙ্কিত।

Advertisement

সরকারের রক্তচাপ এবং আমজনতার ভয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু কিছু খবর ও ছবি। এর কোনটা কতটা খাঁটি, তার বিচার নিশ্চয় বাঞ্ছনীয়। সব সত্যি, তা-ও নয়। কিন্তু যা রটে, তার কিছু বটে— এমন আপ্তবাক্য মনে রাখলে সব অলীক বলে উড়িয়ে দেওয়াও হয়তো অসঙ্গত হবে। আর এই সূত্রেই যে সব কথা প্রকাশ্যে আসছে, তাতে একাধিক করোনা-হাসপাতালের হাল নিয়ে কিছু প্রশ্ন সামনে এসে পড়ে।

এ কথা ঠিক, কোনও বৃহৎ কাজে সব কিছু নিখুঁত, পরিপাটি হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। করোনা নিধনের বিশাল যজ্ঞেও এটা প্রযোজ্য। সর্বোপরি এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলার কোনও অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রস্তুতির সুযোগও ছিল না। শুধু বাংলা কেন, সকলের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি।

Advertisement

আরও পড়ুন: একদিন আসবে সুদিন, অপেক্ষা শুধু সময়ের

কিন্তু কলকাতা-সহ রাজ্যের একাধিক সরকারি ও বেসরকারি করোনা-হাসপাতালে ভর্তির ডামাডোল থেকে শুরু করে রোগীদের পরিচর্যার বিষয়গুলি নিয়ে কিছু কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, অভিযোগ ও সমালোচনা ক্রমশ যে ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রশাসনের পক্ষে তা স্বাস্থ্যকর নয়। এর পিছনে রাজনৈতিক ইন্ধন, চক্রান্ত, ভুয়ো রটনা ইত্যাদি যুক্তি যতই থাক, সবাইকে তা মানানো বা বিশ্বাস করানোও শক্ত হচ্ছে। ফলে সরকারের সব রকম প্রয়াস ও সদিচ্ছা ছাপিয়ে একটা নেতিবাচক ধারণা সমান্তরাল ভাবে কাজ করে চলেছে। বিরোধীরা যার সুযোগ নিতে তৎপর।

সাধারণ ভাবে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ চিরকালীন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার আগেও সাড়ে তিন দশকের বাম রাজত্বে এর কোনও ব্যতিক্রম ছিল না। সেই উত্তরাধিকারই এই আমলে বর্তেছে, বলা চলে। এটা বস্তুত একটি ধারাবাহিকতা। ইউনিয়নবাজি, এক শ্রেণির চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর কাজে গাফিলতি, রোগী বা পরিজনদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা থেকে হাসপাতালে রাজনৈতিক দাদাগিরি, সবই আগে থেকে ছিল, এখনও আছে। কোথাও তার প্রকাশ বেশি, কোথাও কম।

পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলির একাংশের বিরুদ্ধেও অতিরিক্ত ‘ব্যবসায়িক’ মনোবৃত্তি, চিকিৎসায় অবহেলা, ঔদ্ধত্য প্রদর্শন প্রভৃতি অভিযোগ দীর্ঘ দিন ধরে প্রায় রোজনামচা হয়ে উঠেছে। সেই সবের সংখ্যাও খুব নগণ্য নয়। এ সব মিলিয়েই স্বাস্থ্য পরিষেবা!

আরও পড়ুন: ‘ভুল খরচের মহামারি’

যদিও মমতার আমলে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বেশ কয়েকটি বেড়েছে। বাইরের হতশ্রী চেহারাগুলিতেও প্রলেপ পড়েছে। চিকিৎসার খরচ কমানো, সুলভে ওষুধ জোগানো— সবই করেছে এই সরকার। কিন্তু বেশবাস বদলালেই কি স্বভাব রাতারাতি বদলায়! মুশকিলটা মূলত হয়েছে এইখানে।

একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, সম্বৎসর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে যে ধরনের সমস্যা বা অভিযোগের কথা শোনা যায়, এখনকার অভিযোগগুলি তার থেকে চরিত্রে খুব কিছু আলাদা নয়। রোগী জায়গা পেতে নাকাল হবেন, শয্যার পাশে কারও বাড়ানো হাত থাকবে না, দশ বার ডাকলে এক বার এক জনের দায়সারা উত্তর মিলবে বা মিলবেই না, ডাক্তারবাবুরা পাশ কাটিয়ে কিংবা নিজেদের আড়ালে রেখে কর্তব্য সারবেন—এ সব কি খুব অচেনা? ঘটনা হল, সর্বত্র সমান না হলেও বহু ক্ষেত্রে এটাই আজও পরিচিত ছবি। হঠাৎ জাদুমন্ত্রে সব পাল্টে যেতে পারে না।

তবে করোনা-সঙ্কটে হাসপাতাল-নির্ভরতা এখন এক বেনজির পর্যায়ে পৌঁছেছে। আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলির উপর চাপ যেমন কয়েক গুণ বেড়েছে, তেমনই লোকের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত হয়েছে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর। মরণ-বাঁচন যাঁদের হাতে এবং যে রোগ থেকে মুক্তির নির্দিষ্ট পথ এখনও অজানা, সেখানে হাসপাতালগুলিকেই তো সাধারণ মানুষ আঁকড়ে ধরবে। এটাই সময়ের দাবি।

আবার এটাও সঙ্গত, এই পরিস্থিতিতে সেখানে যে কোনও ধরনের অব্যবস্থা, অবহেলা, বিচ্যুতি, ভুলভ্রান্তি সাধারণ সময়ের তুলনায় অনেক গুণ বড় হয়ে দেখা দেবেই। সেটা রোগীদের বেলাতেই হোক, বা রণাঙ্গনে যুদ্ধরত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষেত্রে। মূল বিষয়টি আলাদা নয়। করোনা-চিকিৎসার হাসপাতালগুলিতে ধরা পড়া যে কোনও ছিদ্র সেই কারণেই এক-একটি গহ্বরের চেহারা নিচ্ছে। প্রকৃত গহ্বরের খোঁজ মিললে তো কথাই নেই!

সবাই নিশ্চয় মানবেন যে, কোনও সরকারই চায় না তার জমানায় দলে দলে লোক ভুগে মরুক! এ ক্ষেত্রে ডান-বাম-সবুজ-গেরুয়াতে কোনও প্রভেদ নেই। তাই মোকাবিলার পরিকাঠামো যাঁর যতটা আছে, তিনি প্রাণপণে ততটাই কাজে লাগাতে চাইবেন। কিন্তু সিস্টেমের ভিতরে যদি নানাবিধ ফাঁক, গলদ, অদক্ষতা, অপারগতা জমাট বেঁধে থাকে, সদিচ্ছা বা নীতি তখন কোথাও এসে ধাক্কা খেতে বাধ্য। সরকারের রং বদল হলেও মন্ত্রী-আমলাদের চাওয়া, না-চাওয়া সেখানে হার মেনে যায়।

তবে ক্ষমতায় থাকলে দায় বইতে হয়। মমতাকেও বইতে হচ্ছে। ক্ষোভ, অভিযোগ অনুযায়ী অবস্থা সামলানোর চেষ্টাও জারি আছে। সঙ্গে আছে রাজনীতি, যা এই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য অঙ্গ। শাসক, বিরোধী সবাই এর অংশীদার এবং জনগণ তার উপভোক্তা।

যদিও ‘জনগণ’ অর্থাৎ আমাদের ভূমিকা এই অবসরে একটু ভেবে দেখার মতো! বিরোধিতা এবং পারস্পরিক সমালোচনায় আমরা যতটা সরব ও সক্রিয়, নিজেদের করণীয়টুকু পালনের ক্ষেত্রে কি ততটা সচেতন আমরা? করোনা-যুদ্ধে আমাদের দায়িত্ব আমরা ঠিকঠাক পালন করছি তো? বিপদ বাড়িয়ে তোলার মতো কোনও কাজ আমরা করছি না তো? এই আত্মসমীক্ষাটিও আজ খুব জরুরি।

হাসপাতালের বেহাল দশা আমাদের বাক্রুদ্ধ করছে। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে কাজ করে চলা চিকিৎসক, নার্সদের অভাব-অভিযোগের কথা জেনে আমরা প্রতিবাদ করছি। একদম উচিত কাজ। কিন্তু পরিহাস হল, নিজেদের বেলায় কর্তব্যের প্রাথমিক পাঠগুলিই আমরা ভুলতে অভ্যস্ত! তাই লকডাউনকে কার্যত বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, সামাজিক দূরত্বের বিধিনিয়ম নস্যাৎ করে বাজারের ব্যাগ হাতে দলে দলে যোগ দিতে বেরিয়ে পড়ি আমরাই। মদ কেনার লাইনে গুঁতোগুঁতি করতে করতে টিভি-র ক্যামেরায় হাসিমুখ দেখিয়ে আমরাই বলতে চাই, ‘আজ দিনটা বড় ভাল!’ কে আমাদের রুখবে!

উত্তর কলকাতার অভয় মিত্র স্ট্রিটের সেই প্রবীণ সহ-নাগরিকের কথাই ধরা যাক। এলাকাটি রেড জোন হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার পরের দিনই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকের কাছে চ্যালেঞ্জের সুরে তিনি বলেছিলেন, কোনও নিয়মের ধার তিনি ধারেন না। তাই মাস্ক খুলে রাখবেন এবং সিগারেট খাবেন, যেমন এত দিন করেছেন।

এটি দৃষ্টান্তমাত্র। তবে বলতে দ্বিধা নেই, হাসপাতালের নৈরাজ্য বা মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি যেমন অপরাধ, আমাদের এই সব বেপরোয়া কার্যকলাপ তার চেয়ে কম নয়। কারণ, এ ভাবেই প্রতি দিন ঝুঁকির বহর বাড়িয়ে তুলছি আমরা অর্থাৎ ‘প্রতিবাদী’ জনগণ।

লকডাউন চলাকালীন এই সব খণ্ডচিত্র আগামী দিন আরও বড় আশঙ্কার ইঙ্গিত। কারণ লকডাউন ওঠার পরেও সাধারণ কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে আমরা কে কত দূর সতর্ক থাকব, এ সব থেকেই সেটা কিছুটা বোঝা যায়।

পুলিশ দিয়ে কত দূর মানানো সম্ভব, সেটিও এক বড় সামাজিক প্রশ্ন। কারণ লকডাউনে কোথাও বজ্রআঁটুনি, কোথাও ফস্কা গেরোর উদাহরণ বিস্তর!

তাই সবচেয়ে বড় হল আমাদের সচেতনতা। সেই বোধ আচ্ছন্ন থাকলে কোনও প্রশাসন, কোনও পুলিশ কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন