এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃত্যুভয়। টেলিভিশন থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঘন ঘন আপডেট হচ্ছে করোনাভাইরাসের খবর। শেষ চব্বিশ ঘণ্টায় কতজন আক্রান্ত হলেন? কতজনের মৃত্যু হল? প্রহরে প্রহরে তা বেড়েই চলেছে। ইতালি, স্পেন থেকে আমেরিকার মতো দেশে ক্রমশ তা হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। যে ভাইরাসের কোনও প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি।
বিজ্ঞানীরা রাতদিন এক করে সমুদ্রমন্থন করে চলেছেন। এখনও পর্যন্ত কোনও দেশই সেই অমৃতের সন্ধান করতে পারেনি। আমাদের মতো কোটি কোটি মানুষের দেশে এটা এক আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রনায়কেরা ওই ভাইরাসের হাত থেকে নিজের দেশ, নিজের মাটিকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা এবং কোটি কোটি মানুষের সংখ্যা বলেই দিচ্ছে, সেই কাজ সহজ নয়। তাই প্রকাশ্যে বলে দেওয়া হচ্ছে, লকডাউন ছাড়া যেন আর কোনও পথ খোলা নেই। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগেই লকডাউন শুরু হয়ে যায় দেশে।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার লকডাউনে ভারত যে করোনা-যুদ্ধে খানিকটা হলেও এগিয়ে রয়েছে, তেমন কথা শোনা গিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’র কর্তাদের মুখেও। এই পর্যন্ত সব ঠিকই রয়েছে।
আসলে আমরা কেমন আছি? আমরা যারা এই প্রত্যন্ত কোচবিহার তথা উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। যারা বারবার প্রশ্ন তুলেছি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা নিয়ে। কোনও জটিল অসুখের চিকিৎসা আজও এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেলে না।
প্রত্যেকদিনই কেউ না কেউ এই অঞ্চল থেকে ছুটে যান কলকাতা অথবা দক্ষিণ ভারতে। ঘরবন্দি হয়ে বসে থাকা কতটা সমস্যার হতে পারে তাঁদের কাছের। যেখানে গ্রামের পর গ্রামের মানুষ দিনমজুরির ওপরেই বেঁচে রয়েছেন। যাঁদের একদিন কাজ না করলে পরের দিন হাঁড়িতে ভাত থাকে না, তাঁদের ঘরবন্দি হয়ে থাকা কতটা কষ্টকর। তারপরেও বড় অংশের মানুষ তা মেনে নিয়েছেন। মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ তাঁরা জানেন বা বুঝতে পেরেছেন। আসলে করোনাভাইরাস একবার বাসা বাঁধলে হয়তো বা মৃত্যুর পথে হাঁটতে হবে।
তার পরেও একদল বেপরোয়া মানুষ লকডাউন মানতে চাইছেন না। সকাল থেকেই হাট-বাজার, ব্যাঙ্ক থেকে শুরু নানা কাজের অজুহাতে পথে নামছেন তাঁরা। আর ওই মানুষদের এমন বেপরোয়া মনোভাব দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছেন ঘরে বন্দি হয়ে থাকা বাসিন্দাদের বড় অংশ। বারবার দাবি উঠছে, যাতে ওই বেপরোয়া মানুষদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একদমই ঠিক, কেন অসচেতন কয়েকজনের জন্য যেন দেশের কোটি কোটি মানুষ বিপদের পড়বেন।
প্রশ্ন ঠিক এখানেই, যে মানুষেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাইরে, যাঁরা লকডাউন মানছেন না। তাঁদের কি মৃত্যুভয় নেই! তাঁরা কি ভেবে রেখেছেন, আর যাই হোক করোনা তাঁদের ছুঁতে পারবে না? হতে পারে, নাও হতে পারে। খুব নিবিড় ভাবে যদি লক্ষ করা যায়, এই বেপরোয়া মনোভাব দুই ধরনের মানুষের মধ্যে রয়েছে।
এক, গ্রামের খেটে খাওয়া কিছু মানুষ। যারা প্রতিদিনই লড়াই করছেন বেঁচে থাকার জন্য। একদিন না বেরোলে পরের দিন কী করে সংসার চলবে, ভাবনা যাঁদের কুড়ে কুড়ে খায়। সরকার অবশ্য তাঁদের জন্য ভেবেছে। তাঁদের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়েছে। রেশনে চাল-আটা বিলির কাজও শুরু হয়েছে। বহু মানুষও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সেই সব মানুষের দিকে। যা নতুন করে এক মানবতার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে।
আরেক শ্রেণির মানুষও ঘর থেকে বাইরে বেরোচ্ছেন, যাঁদের আসলে কোনও কাজ নেই। লকডাউনের বাজারে একটু ঘুরে আসি এই মনোভাব নিয়েই বাজার-ব্যাঙ্ক থেকে মিষ্টির দোকান ঘুরে অবশেষে বাড়িতে। ওই তালিকায় রয়েছেন শাসক-বিরোধী সব দলেরই কিছু নেতা-কর্মী-সমর্থক। বিশেষ করে শাসকদলের একটি অংশকে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে মাঠেঘাটে। ত্রাণবিলির সময়ে জমায়েতের অভিযোগ উঠছে।
সেখানে আরও কিছুটা সচেতন হয়ে আরও কিছুটা পরিকল্পনা করে কেন ওই ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে না, সে প্রশ্ন থেকে যায়। স্পষ্ট করেই বলা যায়, এই প্রান্তিক মানুষদের একমাত্র বাঁচার পথ লকডাউন। নিছকই মজা করে বাইরে যাঁরা বেরোচ্ছেন, তাঁদের অবশ্যই পুলিশকে লাঠিপেটা করতে হবে। কে কোন দলের বা কার কতটা ক্ষমতা, সে সব না দেখেই ব্যবস্থা নিতে হবে পুলিশকে। আর যাঁদের ঘরে খাবারে টান পড়েছে, সেখানে খাবার পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হতে হবে সরকার তথা প্রশাসনকে। তা হলে লকডাউন আরও সফল হবে এ কথা হলফ করেই বলা যায়।
না, এখানেই শেষ নয়। লকডাউন সকলকে মানতে হবে। সেই সঙ্গে উন্নত করতে হবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার। চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী থেকে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সব গড়ে তুলতে হবে প্রান্তিক শহরে। সবই যাতে সেই রাজধানী মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে না হয়। মিষ্টির দোকান খুলছেন খুলুন, কাঁসর-ঘণ্টা বাজাচ্ছেন, মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন, সেও ঠিক আছে।
সেই সঙ্গে আমাদের এই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের বেঁচে থাকা সুনিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা হোক।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)