Coronavirus

সংগচ্ছধ্বম্

এমন অনিশ্চিত, ভীতিপূর্ণ ভবিষ্যতের সম্মুখীন হইলে মানুষের মধ্যে আত্মরক্ষার ইচ্ছা প্রবল হইয়া উঠে। তাহা অপর সব বিবেচনাকে আচ্ছাদিত করিয়া দিতে চায়। আমেরিকা, ইউরোপ হইতে এশিয়ার নানা দেশে দোকান বাজার প্রায় লুণ্ঠিত হইয়াছে এই কারণেই।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৬
Share:

প্রতীকী ছবি

কেহ চলচ্ছক্তিহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ঔষধ, আহার্য পৌঁছাইয়া দিতেছেন। কেহ কর্মহীন দিনমজুরদের জন্য চাল-ডাল সংগ্রহ করিতেছেন। কেহ নিজের বাসগৃহ উন্মুক্ত করিয়াছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য। মহামারি এড়াইতে গোটা দেশ যখন ঘরবন্দি, পরিচিত জীবনযাত্রা স্তব্ধ হইয়াছে, তখন বহু নাগরিক কোনও প্রতিদানের আশা না করিয়া, অপরের পাশে দাঁড়াইতেছেন। সংখ্যায় তাঁহারাই অধিক, এমন দাবি করা চলিবে না। মনুষ্যসমাজে বরাবর স্বার্থপরতার দিকে পাল্লা ঝুঁকিতে চায়, সঙ্কটকালে স্বার্থরক্ষার তাড়না প্রায়শ নগ্ন রূপে প্রকাশ পায়। এই বারও তাহার ব্যত্যয় হয় নই। কিছু মানুষ প্রয়োজনীয় পণ্য লইয়া প্রতিবেশীর সহিত যে রূপ মারামারি করিয়াছেন, তাহাতে লজ্জা জাগিতে বাধ্য। হয়তো সেই কারণেই সহৃদয়তার যে সকল নিদর্শন দেখা যাইতেছে, তাহা আরও বিস্মিত করে। সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স চরম অস্থিরতার কাল সম্পর্কে বলিয়াছিলেন, তাহা ছিল একই সঙ্গে সর্বোৎকৃষ্ট এবং সর্বাধিক অপকৃষ্ট এক সময়। আজ তেমনই এক দুঃসময়। করোনাভাইরাসজনিত অচলাবস্থার কারণে বহু মানুষের অসুস্থতা ও মৃত্যু ঘটিয়াছে। আরও ঘটিবে। অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক মন্দা সমাজে কত গভীর ক্ষত তৈরি করিবে, কত মানুষ কর্মহীন, খাদ্যহীন হইবে, কে বলিতে পারে?

Advertisement

এমন অনিশ্চিত, ভীতিপূর্ণ ভবিষ্যতের সম্মুখীন হইলে মানুষের মধ্যে আত্মরক্ষার ইচ্ছা প্রবল হইয়া উঠে। তাহা অপর সব বিবেচনাকে আচ্ছাদিত করিয়া দিতে চায়। আমেরিকা, ইউরোপ হইতে এশিয়ার নানা দেশে দোকান বাজার প্রায় লুণ্ঠিত হইয়াছে এই কারণেই। এরই মধ্যে কিছু মানুষ যে অপরের প্রয়োজন মনে রাখিয়া, নিজের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করিয়া ত্রাণ ও সহায়তার নানা উদ্যোগ করিয়াছেন, তাহা গোটা সমাজকেই আশ্বস্ত করিতেছে। যখন বাহিরের সম্পদ নষ্ট হইয়াছে, তখনই চাহিতে হইবে আত্মশক্তির দিকে।

পারস্পরিক আস্থা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টাই মানুষের শক্তি। বহু যুগ পূর্বে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুণী সকলের ঘর হইতে মুষ্টিভিক্ষা করিয়া দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা মিটাইবার পথ দেখাইয়াছিলেন। সেই পথ বাহিয়াই ভারত বারংবার দেখিতেছে, মহামারিতে পীড়িত, দুর্যোগে সর্বস্বান্ত, যুদ্ধ-দাঙ্গায় বিপর্যস্তদের জন্য শুশ্রূষা ধনীর গৃহ হইতে আসে নাই। আসিয়াছে সাধারণ গৃহস্থ বা অকিঞ্চন সন্ন্যাসীর হাত ধরিয়া। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা গিয়াছে, রাজনৈতিক দল বা সমাজসেবামূলক সংগঠনগুলি সক্রিয় হইবার পূর্বেই বহু নাগরিক পরস্পর সমন্বয় করিয়া সহায়তার কর্মকাণ্ড শুরু করিয়াছেন। বহু ক্ষেত্রে তাঁহারাই আর্তদের অবস্থান ও প্রয়োজনের প্রতি সরকারি আধিকারিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। এমন নাগরিক সক্রিয়তার একটি ধারা বারংবার জনজীবনকে সঞ্জীবিত করিয়াছে। কেরলে বিধ্বংসী বন্যা, দিল্লির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এবং এখন মহামারি-জনিত অচলাবস্থা, প্রতিটি ক্ষেত্রে আর্ত, গৃহহীন, সর্বস্বান্ত মানুষদের জন্য যাঁহারা অগ্রণী হইয়াছেন, তাঁহারা ধনকুবের শিল্পপতি কিংবা ক্ষমতাদর্পী নেতার বদান্যতার অপেক্ষা করেন নাই। সম্মিলিত শক্তিই তাঁহাদের বল, মুষ্টিভিক্ষাই তাঁহাদের সম্পদ। অতল অনিশ্চয়তার মুখে ভারতবাসীর যদি কোনও ভরসা থাকে, তবে তাহা ‘সংগচ্ছধ্বম্’ মন্ত্র।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন