Coronavirus

‘যাহাদের সুখের সম্বল আছে তাহারা সুখেই আছি’

মহামারিও একদিন থামবে। এই মহামারির ইতিহাসে লেখা থাকবে ‘এই…ভীষণ দুঃখের সম্বন্ধে আমরা কিরূপ ব্যবহার করিলাম’ তার কথাও। লিখছেন সুদীপ জোয়ারদারছাত্রবয়সে আমরা সবাই নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পড়েছি, ‘আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।’

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০ ০৭:১৮
Share:

রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গিয়েছেন অভয়মন্ত্র, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না। / দুবেলা মরার আগে মরব না, ভাই মরব না।’ কিন্তু চারদিকে এত খারাপ খবর, সাহস কীভাবে আনা যায়! এর উপরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথেরই ‘রোগীর বন্ধু’, মানে দুঃখীরামের দল। এমনিতেই আমরা বৈদ্যনাথের চেলা। রোগভয়ে ভীত। তার উপরে সোশ্যাল সাইটে দুঃখীরামেরা সব সময় ছড়িয়ে চলেছেন সভয়বাণী। ভয় তাই শুধু তার ছায়াই বিস্তার করছে না, অনায়াসে পৌঁছে যাচ্ছে আতঙ্কে।

Advertisement

ছাত্রবয়সে আমরা সবাই নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পড়েছি, ‘আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।’ সে ভীতির সঙ্গে তখন আমাদের পরিচয়ও কিছু হয়েছিল। ‘এইবার গ্রামে মহামারী শুরু হইয়া গেল। যাহার পলাইবার স্থান ছিল, সেই পলাইল। অধিকাংশেরই ছিল না, তাহারা ভীত শুষ্ক-মুখে সাহস টানিয়া কহিল, অন্নজল ফুরাইলেই যাইতে হইবে, পলাইয়া কি করিব?’ শরৎচন্দ্রের ‘পন্ডিতমশাই’এ এই মহামারীর নাম ছিল ওলাওঠা। গ্রামবাংলার সে সময়ের মূর্তিমান বিভীষিকা। বৃন্দাবনের মা, ছেলে মারা গেলেও এই মহামারীর ভীতিতেও একটা জানালা তবু খোলা ছিল, ‘যাহার পলাইবার স্থান ছিল পলাইল।’ কিন্তু এ মহামারী তো সর্বব্যাপী! কোথায় পালাব আমরা! সত্য, অর্ধসত্য, ভুয়ো খবরের আতঙ্ক তাই গিলতে আসছে হাঁ করে।

এই মহামারীর আবার নিদানটাও আলাদা। পালানো নয়। ঘরে থাকা। কিন্তু ঘরে থেকেও কি শান্তি আছে? এ ভাইরাস দেহে ঢুকলে প্রকাশিত হতে অনেকটা সময় নেয়। সুতরাং ঘরেও সাবধানতা, পরস্পরের থেকে দূরত্ব। উপসর্গগুলো কমবেশি সবাইই জেনে গিয়েছি। একটা হাঁচি হলেই তাই প্যালপিটিশন। একটু খুকখুক কাশি হলে নিজের ও আশেপাশের লোকেদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। বারবার ঢোক গিলে পরীক্ষা চলছে, গলার কোথাও কোনও ব্যথাভাব আছে কি না। প্রচন্ড গরম, কিন্তু ফ্যান চালাবার সাহস হচ্ছে না। যদি ঠান্ডা লেগে যায়। এমনিতেই বিনা কারণে থার্মোমিটার মাঝে মাঝে চালান হচ্ছে বগলের তলায় অথবা জিভের নীচে। ঠান্ডা লেগে গা গরম হলে তখন চিন্তা বাড়বে, এমনি জ্বর, না করোনার!

Advertisement

আর সব মানুষই এখন সন্দেহের তালিকায়। রাস্তায় খুব প্রয়োজনে বেরোলে, মানুষ দেখলেই ভয়। তাড়াতাড়ি হাঁটা। দূরত্ব তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা। বাঁচতে হবে, যে করেই হোক বাঁচতে হবে। কিন্তু শুধু কি নিজেই বাঁচব? ‘পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল। পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এ জন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন…চেষ্টা করিয়া নিজের বাড়িতে প্রাইভেট হাসপাতাল বসাইলেন’ (‘চতুরঙ্গ’/রবীন্দ্রনাথ)। ভরসার কথা, এমনতর সামাজিক কাজ এই করাল করোনাতেও দুর্লক্ষ্য নয়। তবে যথেষ্ট যে নয়, তা বলাই যায়।

জগমোহন বাড়িতে হাসপাতাল বসালেও নিজে বাঁচেননি প্লেগের হাত থেকে। তাঁর হাসপাতালে দ্বিতীয় রোগীই ছিলেন তিনি। মৃত্যু নিয়ে তাঁর কোনও খেদ ছিল না। ‘এতদিন যে ধর্ম মানিয়াছি, আজ তার শেষ বকশিশ চুকাইয়া লইলাম, কোনো খেদ রহিল না।’ জগমোহনের ধর্ম, ‘চতুরঙ্গ’-এর পাঠকেরা জানেন। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।’ এ কথা আমরাও তো বলে এসেছি নানা উপলক্ষে এ যাবৎ। এখন এই ক্রান্তিকালে, তা শৌখিন ভাববিলাসিতা ছিল কি না, তার পরীক্ষা। পরীক্ষা আমাদের দেশানুরাগেরও।

লকডাউনে নানা জায়গায় আটকে পড়া মানুষের কষ্টের নানা ছবি উঠে আসছে সংবাদ মাধ্যমে। কোথাও কর্মচ্যুত বন্দি মানুষ একই সঙ্গে লড়ছেন মহামারি ও অনাহারের সঙ্গে। আবার কোথাও দলে দলে মানুষ হাঁটছেন রাস্তা ধরে। তাঁদের কাছে মহামারির ভয়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছে পথশ্রমের ক্লান্তি ও ক্ষুধা। আমরা সচেতন মধ্যবিত্ত কয়েকদিন ঘরে বন্দি হয়েই কষ্টের জার্নাল খুলে বসেছি। অথচ ওরা…!

মহামারি প্রবল হয়ে উঠলে কী হবে তা অজানা। তবে এখনও পর্যন্ত আমরা সাধারণ কর্মজীবী মধ্যবিত্ত খুব বেশি দৈহিক যাতনা ভোগ করিনি।

বরং রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, ‘দেশের দারুণ দুর্যোগের দিনে আমাদের মধ্যে যাহাদের সুখের সম্বল আছে, তাহারা সুখেই আছি। যাহাদের অবকাশ আছে, তাহাদের আরামের লেশমাত্র ব্যাঘাত হয় নাই, ত্যাগ যেটুকু করিয়াছি, তাহা উল্লেখযোগ্য নয়, কষ্ট যেটুক সহিয়াছি আর্তনাদ তাহা অপেক্ষা অনেক বেশিমাত্রায় করা হইয়াছে’ (‘দেশনায়ক’)।

মহামারির প্রবল হয়ে ওঠার আশঙ্কা মিথ্যে হোক, সকলেরই এখন একমাত্র প্রার্থনা। কিন্তু সে প্রার্থনাকে সফল করে তুলতে গেলে একুশ দিনের লম্বা এই গৃহবন্দিত্বে কোনও ফাঁক রাখা চলবে না।

ফাঁক যে এখনও যথেষ্ট তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত পরিযায়ী মানুষদের ঘরে ফেরার ছবিতেই পরিষ্কার। পরিষ্কার এখনও কিছু মানুষের বেপরোয়া এবং অসতর্ক আচরণেও।

পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুর মিছিল চলছে। সমস্ত পৃথিবীটাই এখন আলবেয়ার কামুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের শহরটি। সেই একই বন্দিদশা দেশে দেশে। এবং রোগের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। তবে ভরসার কথা কর্তব্যপরায়ণ ডাক্তার, মাঠে নেমে কাজ করা সাংবাদিকদের দেখা যাচ্ছে অনেক। ওরাওঁ শহরে প্লেগ শুরু হয়েছিল এপ্রিলে আর তার আক্রমণ প্রশমিত হয়েছিল পরের বছর ফেব্রুয়ারি নাগাদ।

এই মহামারি কবে থামবে তার উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে সব দুঃখের রাত্রিরই অবসান আছে। এই মহামারিও তাই একদিন থামবে। কেউ হয়ত ‘দ্য প্লেগ’ এর মতো কালজয়ী উপন্যাসও লিখবেন এই মহামারীর প্রেক্ষাপটে।

শুধু তাই নয়। এই মহামারির ইতিহাসে লেখা থাকবে ‘এই…ভীষণ দুঃখের সম্বন্ধে আমরা কিরূপ ব্যবহার করিলাম’ তার কথাও।

লেখক শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন