মহারাষ্ট্রের বিজেপি বিধায়ক রাজ পুরোহিত বলেছেন, ‘‘এ তো শুধু ট্রেলার।’’ মানে, পিকচার আভি বাকি হ্যায়। হ্যাঁ, ‘পদ্মাবতী’ নামক সিনেমাটি নিয়ে সারা দেশে কিছু দিন ধরে যা চলছে, তা নিজেই সিনেমার চেয়ে কিছু কম নয়। তাও এ নাকি ট্রেলার! সেই ট্রেলারে অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোনের নাক কেটে নেওয়া আছে, তাঁকে জ্যান্ত পোড়ালে এক কোটি টাকা ইনাম দেওয়ার ঘোষণা আছে, শেষ পর্যন্ত পরিচালক এবং দীপিকা, দু’জনেরই মাথা কেটে আনলে ১০ কোটি টাকা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি আছে। এই সব ইনাম ঘোষকদের কেউ জোর গলায় ধমকাচ্ছেন না, গ্রেফতার করা তো দূর অস্ত্। এবং এখন ছবির মুক্তিই অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গিয়েছে! এমন ট্রেলার থাকতে সিনেমা মুক্তি না পেলেই বা ক্ষতি কী?
আমার দেশের এক পরিচালক একটি সিনেমা বানিয়ে আমাকে কিছু বলতে চেয়েছেন। রাষ্ট্র বা তথাকথিত দেশভক্তদের কী অধিকার আছে আমাকে তা থেকে বঞ্চিত করার? ভংসালী মশাই কেমন পরিচালক, দীপিকা কেমন অভিনেত্রী, পদ্মাবতী চরিত্র কতখানি ঐতিহাসিক (কোথাও বলা হয়নি এটি বায়োপিক বা জীবনীচিত্র), এই সিনেমাটি মানগত ভাবে কেমন, ইতিহাস বিকৃত হয়েছে কী হয়নি, এ সব বুঝে নেওয়ার বিষয়ে ভারতের নাগরিকদের কেউ কীভাবে অক্ষম মনে করতে পারেন? যে সিনেমা কেউ দেখলেনই না, তার শুটিংয়ে তাণ্ডব চলল, দৃশ্য বাদ দিতে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া হল, শয়ে শয়ে মিটিং মিছিল হল, ফতোয়ার বন্যা বয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত রিলিজ পিছিয়ে গেল। কেউ ভাবলেন না, এ বিষয়ে দেশের সাধারণ নাগরিকদের একটি মত থাকতে পারে এবং তাঁদের সিনেমাটি দেখতে দেওয়া দরকার।
ভারতের ফিল্ম সেন্সর বোর্ড (একটা গালভরা নাম আছে তাঁদের— সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন, কিন্তু পুরনো সেন্সর বোর্ড নামটাই মানায় ভাল) মহা কীর্তিমান, এ আর নতুন কথা কী? ১৯৫৯ সালে ‘নীল আকাশের নীচে’, ১৯৬৩ সালে ‘গোকুল শংকর’, ১৯৯৪ সালে ‘ব্যান্ডিট কুইন’, ২০১১ সালে ‘ছত্রাক’— কয়েকটি দৃষ্টান্তমাত্র— এমন কত সিনেমার উপর যে তার দৃষ্টি পড়েছে, গুনে শেষ করা যাবে না। আপত্তির কারণ কখনও রাজনীতি, কখনও ধর্ম, কখনও নগ্নতা, আরও কত কী। কিন্তু সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে ২০১৫-১৬ সময়কাল, যখন সাতাত্তরটি ছবির উপর তাঁদের কোপ পড়েছে। ‘উড়তা পঞ্জাব’, ‘লিপ্সটিক আন্ডার মাই বুরখা’, ‘মারসেল’, অস্কারে যাওয়া ‘মুনলাইট’ এ সব ছবি তো আছেই, বিশ্ববরেণ্য অমর্ত্য সেনের বক্তৃতাকেও তাঁরা ছেড়ে কথা বলেননি।
আমরা বুঝি না, কেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে চিঠি লিখে ছবি থেকে আপত্তিকর দৃশ্য বাদ দিতে বলেন? মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, তাঁর রাজ্যে ছবিটি মুক্তি পাবে না। এমনকী পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীও ছবিতে ইতিহাস বিকৃতি দেখেন। কংগ্রেসের শশী তারুর পর্যন্ত করণী সেনার দাবিতে যথার্থতা খুঁজে পান! কলকাতা শহরে একটি সিনেমা হলে হাজির হয় বজরং সদস্যরা।
আজ যাঁরা পদ্মাবতীর সঙ্গে চিতোরের রানি পদ্মিনীর মিল খুঁজে ‘ইতিহাস বিকৃতি’র স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদের আপত্তির একটি বড় কারণ নাকি আলাউদ্দিন খিলজির সঙ্গে রানি পদ্মিনীর একটি স্বপ্নদৃশ্য। এই স্বপ্নদৃশ্যের কথাও পরিচালক নিজে অস্বীকার করেছেন। না করলেই বা কী হত? আমরা ভাল লাগলে সিনেমাটি দেখতাম, খারাপ লাগলে দেখতামই না। দেশভক্তরা আপত্তিকর দৃশ্য কেবল সিনেমায় দেখতে পান। জহর ব্রতর যন্ত্রণা বোঝাতে এক জন মহিলাকে পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব, পরিচালককে জুতোর ভাষা বোঝানো, ছবি নির্মাতার পরিবারের মহিলাদের বিরুদ্ধে বহুগামিতার মতো অশ্লীল অভিযোগ আনা, এর কোনও কিছুতে তাঁরা আপত্তির কিছুই দেখতে পান না!
মেবারের রাজপরিবার আবার আশ্বাস দিয়েছেন, মধ্যস্থতা করবেন। যেন ইতিহাস কোনও পরিবারের নিজস্ব সম্পদ। পহলাজবাবু তো এর আগে নানান কীর্তির স্বাক্ষর রেখেই গিয়েছেন, এখন ব্যাটন অন্য হাতে। নিন্দুকে অবশ্য ক্ষমতার উৎস এক জায়গাতেই খোঁজে। আমাদের, মানে দর্শকদের তো আর সেই সাজঘরে ঢোকার প্রবেশাধিকার নেই, কাজেই আমরা মঞ্চের পরদা ওঠার অপেক্ষায়।
জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, ‘আমাকে সেই স্বাধীনতা দাও, যাতে আমি মুক্তকণ্ঠে বলতে পারি, তর্ক করতে পারি বিবেকের তাড়নায়, সবচেয়ে বড়কথা স্বাধীনভাবে।’ গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের যদি এই বাক্স্বাধীনতা থেকে থাকে, তবে শোনা ও দেখার স্বাধীনতাই বা থাকবে না কেন? আমার এবং ভংসালী মশাইয়ের মাঝখানে সেনা, কুশপুত্তলিকা, ফতোয়া, সেন্সর, রাজনীতি, ভোট, এ সব আসবে কেন? ‘শিল্পসাহিত্যের স্বাধীনতার পক্ষে আছি’, বাঙালি হিসাবে এমন বড়াই আর ধোপে টেকে না। ও আমলে ‘সিটি অব জয়’, এ আমলে ‘কাঙাল মালসাট’ আমাদের ঠোঁটের উপর আঙুল রাখে। তবু আশায় বাঁচি আমরা! তাই ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনৈতিক দল, সরকার, সেন্সর বোর্ডের কাছে আবেদন জানাই, আমাদের ‘পদ্মাবতী’ দেখতে দিন। আমরাই বুঝে নেব।