নরেন্দ্র মোদী। —নিজস্ব চিত্র।
সময় হল সবচেয়ে বড় পরীক্ষক। হেড এগজামিনার বলতে পারেন। ’৮৪ সালে কী বিপুল ভোটে রাজীব গাঁধী ক্ষমতায় এসেছিলেন। মাত্র তিন বছর পর ‘মিস্টার ক্লিন’ হয়ে গেলেন বোফর্স গাঁধী। নরসিংহ রাও ’৯১ সালে ভারতে উদারবাদের জনক। মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল স্টক মার্কেটের দালালের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার। ইন্দিরা গাঁধীর নামই বা বাদ দিই কেন? ’৭১ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে মা দুর্গার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য তিনি তখন দেবী। মাত্র চার বছর পর সিপিএমের দেওয়াল লিখন, ইন্দিরা গাঁধী ডাইনি। আসছে জরুরি অবস্থা। ভারতের রাজনীতিতে তাই রুমালের এই বিড়াল হয়ে যাওয়ার রূপান্তর পর্ব কিন্তু বার বার। সমস্যা হচ্ছে, রাষ্ট্রনেতারা যখন দুর্বল হন, তখন আরও একনায়কতন্ত্রী হন। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তগ্রহণের ঐতিহ্য আছে। নোট-বদলের নাটক দেখার পর মনে হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী সেটা বিস্মৃত হয়েছেন। উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, তাঁর যাবতীয় মৌলিক আইডিয়া এবং সফল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত জন্ম নিয়েছে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে। অনেকটা পাথরে-পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর মতো।
মনে পড়ছে বিজেপির প্রয়াত নেতা প্রমোদ মহাজন আমাকে এক বার বলেছিলেন, কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে প্রধান ফারাক কি জান? বিজেপিতে যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কমপক্ষে চার-পাঁচ জন মিলে। অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আডবাণী তো আছেনই, তার সঙ্গে আছেন যশোবন্ত সিংহ, যশবন্ত সিনহা, মুরলিমনোহর যোশীর মতো আরও কয়েক জন। আর কংগ্রেস পার্টিতে চিরকালই সিদ্ধান্ত নেন এক জন। এক জন মানে গাঁধী পরিবার। কখনও নেহরু, কখনও ইন্দিরা, এখন সনিয়া গাঁধী। কাজেই কংগ্রেসের মডেলটি একনায়কতন্ত্রের মডেল আর বিজেপির কর্মপদ্ধতিটি গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রের বিপদ আছে। নানা মুনির নানা মত। যুক্তি-তক্কো লেগেই থাকে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাই বাজপেয়ী জমানায় অনেক সমস্যা হত। এমনকী, কার্গিল যুদ্ধের সময় পর্যন্ত মতপার্থক্য হত। আডবাণী মনে করেছিলেন, নিয়ন্ত্রণরেখা না পেরিয়েও যদি পাক অধিকৃত কাশ্মীরে আক্রমণ হানা যায়। যাকে বলা হয়, ‘হট পারস্যুট’। রুশ সারফেস টু সারফেস মিসাইল দিয়ে নাকি সে কাজ সম্ভব বলে রায় দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহ কিন্তু সে প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। যশোবন্ত এবং সে দিনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রয়াত ব্রজেশ মিশ্র নাকি মনে করতেন আক্রমণ দিয়ে কখনওই আক্রমণের জবাব হয় না। এই তর্ক-বিতর্ক ব্যাপারটাই তো গণতান্ত্রিক। সিদ্ধান্ত গ্রহণে যদি অসুবিধা হয় তো হোক, তবু বলব এই ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ পদ্ধতি অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
ইন্দিরা গাঁধীর সময়েও এ হেন রাজনৈতিক চামচাবৃত্তি কার্যত মহামারীর পর্যায়ে পৌঁছে যায়। দেবকান্ত বড়ুয়ার মতো লোকের মন্তব্য: ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’ ছিল এই নির্লজ্জ তোষামোদের এক চূড়ান্ত নিদর্শন।
আজ এত বছর পর নরেন্দ্র মোদীর জামানাতেও এই রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এখন বিজেপি নামক দলটির সমার্থক শব্দ হল নরেন্দ্র মোদী। কাজেই এই সব কাজের যাবতীয় সাফল্যের কৃতিত্ব অন্য কারও নয়। নরেন্দ্র মোদীর। মোদী আজকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকেও কিছু বললে অন্য মন্ত্রীরা সমবেত ভাবে টেবিল চাপড়ান। সমবেত ভাবে হাততালি দিয়ে ওঠেন। নোট বদলের মতো একটা সাঙ্ঘাতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গোপনীয়তা রক্ষা করা প্রয়োজন, কিন্তু তাই বলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করবেন না!
ভারতের সম্রাট অশোক বাল্যকালে তক্ষশীলায় পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আলেকজান্ডারের শিক্ষক অ্যারিস্টটলের প্রভাব তাঁর উপর খুব বেশি ছিল। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, রাজাকে সুপণ্ডিত দার্শনিকদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে। রাজার কাজ শুধু বক্তৃতা দেওয়া নয়। রাজা তার শিক্ষাকে ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগাবেন। অ্যারিস্টটলের উপদেশ ছিল, রাজাকে প্রজার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। কৌটিল্যও তো বলেছিলেন, রাজার কাছে তাঁর প্রজা সন্তানসম। অশোকের প্রধান কলিঙ্গ শিলানুসানে এই কথারই তো প্রতিধ্বনি শুনি। সেখানে সম্রাট অশোক বলছেন, সমস্ত মানুষ আমার সন্তান।
নরেন্দ্র মোদীর রাজধর্ম কি এই সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রাখছে? গত ৮ নভেম্বর লালকৃষ্ণ আডবাণীর জন্মদিন ছিল। সে দিন সকালে আমিত শাহকে নিয়ে প্রাতঃরাশ করতে এসে পড়েন মোদী, কিন্তু সে দিনও নোট বদলের রাজনীতি নিয়ে তাঁরা আডবাণীর সঙ্গে কোনও কথাই বলেননি। নোট বদলের সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের উপর এক প্রবল নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, এমনটাই মনে হচ্ছে আমার। আমি ভুল হতে পারি। হতে পারে এই ঝুঁকি নিয়ে মোদীর নির্বাচনী রাজনৈতিক ফায়দা হবে। সে যা-ই হোক, এ কথা সবাই মানবেন যে আর যাই হোক, ভারতের মতো এক বিশাল বহুত্ববাদী দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে একনায়কতন্ত্র চলে না। বরং এক যৌথ নেতৃত্বের মডেলে দেশ চালান ভাল। তাতে জোট গঠন হয় তো হোক। কিন্তু আর যাই হোক সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে না।