প্রবন্ধ ১

নোট বদলের ধাক্কার ছবি কেন পরিসংখ্যানে নেই

ফে ব্রুয়ারির ২৮ তারিখ সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গানাইজেশন (সিএসও) ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হিসেব প্রকাশ করল।

Advertisement

সুরজিৎ দাস

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

বাজার: সরকারি পরিসংখ্যান যা-ই বলুক না কেন, নোট বাতিলের ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বেশ বড়সড় ধাক্কা লেগেছে। এএফপি

ফে ব্রুয়ারির ২৮ তারিখ সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গানাইজেশন (সিএসও) ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হিসেব প্রকাশ করল। জানা গেল, ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ভারতের জিডিপি যা ছিল, ২০১৬ সালে সেই সময়ে জিডিপি বেড়েছে তার ৭ শতাংশ। পরিচিত ভাষায় বললে, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার হয়েছে ৭ শতাংশ। সংখ্যাটির দিকে বলতে গেলে গোটা দেশেরই নজর ছিল, কারণ ডিমনিটাইজেশন বা নোট বদল ঘটেছিল এই সময়েই। অর্থনীতির ওপর তার কুপ্রভাব কতখানি পড়ল, দেখার আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক।

Advertisement

অভিজ্ঞতা বলছে, ৮ নভেম্বর নোট বদলের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার পর দেশ জুড়ে তার ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বড় ধাক্কা খেয়েছে। জিডিপি-র হিসেবে তার প্রতিফলন ঘটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা গেল, সরকারি হিসেব বলছে এই অর্থবর্ষের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ভারতীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্য গত বছরের তুলনায় ভাল হয়েছে। বস্তুত, ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে জাতীয় আয় যতখানি বেড়েছিল, সিএসও-র হিসেব বলছে, এই অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার তার চেয়ে বেশি। অবাক হওয়ার মতোই কথা।

ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৯৮ শতাংশই আসে তিনটি ক্ষেত্র থেকে— এক, ভোগব্যয় (জিডিপি-র ৫৮.৭%); দুই, সরকারি ব্যয় (১০.৫%); এবং তিন, বিনিয়োগ (২৯.১%)। সিএসও হিসেব দিয়েছে, এই বছর তৃতীয় ত্রৈমাসিকে বিনিয়োগ বাড়বে ৩.৫%, সরকারি ব্যয় বাড়বে ২০%, এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, মূল্যবৃদ্ধির হার বাদ দিয়েই ব্যক্তিগত ভোগব্যয় বাড়বে ১০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ, গত অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় এ বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে জাতীয় আয় যতখানি বাড়ছে বলে সিএসও-র হিসেব, তার ৮২.৫% বাড়ছে ভোগব্যয়ের দৌলতে।

Advertisement

হিসেবের সবচেয়ে বড় গোলমাল এখানেই। নোট বদলের পরও ভোগব্যয় ১০%-র বেশি হারে বাড়বে, এটা প্রায় অবিশ্বাস্য। ধরে নেওয়া যাক, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভোগব্যয় যতখানি ছিল, পরের তিন মাসেও তা-ই থাকল, অর্থাৎ নোট বদলের প্রভাবেও ভোগব্যয় কমল না— তা হলে ছবিটা কী দাঁড়ায়? অন্য ক্ষেত্রগুলিতে সিএসও যা হিসেব দিয়েছে, সেগুলোকে সত্যি ধরে নিলেও জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার কমে এক শতাংশেরও নীচে চলে যাচ্ছে। আর, যদি ধরে নিই, নোট বদলের ফলে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ভোগব্যয় ১০% হ্রাস পেয়েছে? তা হলে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার শূন্যেরও ঢের নীচে চলে যাবে— একেবারে -৫%। অর্থাৎ, জিডিপি ৫% সঙ্কুচিত হবে। সিএসও-র হিসেব দাঁড়িয়ে আছে একটা পূর্বানুমানের ওপর— এই অর্থবর্ষে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ভোগব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ১১%। হিসেবটা গোলমেলে, সন্দেহ নেই।

গোলমালটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, না কি সিএসও-র হিসেবনিকেশের পদ্ধতিতেই ভূত? না কি, দুটোই সত্যি? জয়তী ঘোষ লিখেছেন, ত্রৈমাসিকের ‘অ্যাডভান্সড এস্টিমেট’ চির কালই গোলমেলে, তাকে খামখা গুরুত্ব দেওয়ার কোনও অর্থ নেই। সিএসও-কেও দোষী ঠাওরানোর মানে হয় না। অর্থনীতি যে ধাক্কা খেয়েছে, সে কথাটা রিভাইজড এবং অ্যাকচুয়াল এস্টিমেট থেকেই স্পষ্ট হবে। সেই পরিসংখ্যান পেতে সময় লাগে এক থেকে দুই বছর। প্রভাত পট্টনায়কের মতে আবার, এই ত্রৈমাসিকে সাত শতাংশ বৃদ্ধির হারের পিছনে গত অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনামূলক কম আয়ের প্রভাব আছে। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলে লো বেস এফেক্ট।

নির্মাণক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার হিসেব করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন সংস্থার ব্যালান্সশিটের পরিসংখ্যান। অর্থাৎ, এই হিসেব সংগঠিত ক্ষেত্রের প্রধানত বড় সংস্থাগুলির। অসংগঠিত ক্ষেত্রের খবর এই হিসেবে নেই। প্রতি মাসে যে শিল্পোৎপাদনের সূচক (ইনডেক্স অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন বা আইআইপি) প্রকাশিত হয়, তার হিসেব বলছে, তৃতীয় ত্রৈমাসিকে শিল্পোৎপাদনের হার বেড়েছে বাৎসরিক হিসেবে মাত্র এক শতাংশ। অন্য দিকে, সিএসও-র হিসেবে দেখা যাচ্ছে, নির্মাণ ক্ষেত্রে গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড-এর বৃদ্ধি হয়েছে ৮.৩%। বোঝাই যাচ্ছে, হিসেবের কোনও ঠিকঠিকানা নেই।

কর্পোরেট ক্ষেত্রের ছবিটাও একেবারেই ভাল নয়। ক্রেডিট রেটিং সংস্থা আইসিআরএ প্রায় ১,১০০ (তুলনায় বড়) কর্পোরেট সংস্থার উৎপাদনের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, সেখানে টাকার অঙ্কেই বৃদ্ধির হার মাত্র ৪.৪ শতাংশ। অর্থাৎ, মূল্যস্ফীতির পরিমাণ বাদ দিলে প্রকৃত বৃদ্ধি অতি কম। কাজেই, গোটা দেশে শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ ৮.৩ শতাংশ হারে বেড়েছে, এ হেন সরকারি পরিসংখ্যানকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যদিও বা কিছু মাসিক পরিসংখ্যান আছে, রাজ্য সরকারগুলোর কাছে তা নেই। প্রাথমিক সমীক্ষা থেকে যে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, কৃষি এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে সেই তথ্য হাতে আসার সময় হয়নি। ফলে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের জিডিপি-র আঁক কষতে গিয়ে সিএসও-কে কার্যত দড়ির ওপর হাঁটতে হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদসূত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে আমরা জানি, এ বছর কৃষকরা খরিফ শস্যের যথেষ্ট দাম পাননি, কারণ উৎপাদনের একটা বড় অংশ বাজারেই পৌঁছয়নি। ট্রাকের পর ট্রাক খালি করে চাষিরা রাস্তায় টমেটো ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, এই ছবিটা তো কিছু দিন আগেই সব কাগজে বেরিয়েছিল। উৎপাদন শিল্পের গায়েও বেশ কিছু ধাক্কা লেগেছে। আলিগড়ের তালাচাবি তৈরির কারখানা বা ফিরোজাবাদের চুড়ির কারখানা— অত্যাবশ্যক নয়, এমন হরেক উৎপাদন শিল্পের অবস্থা খারাপ। নোট বদলের ধাক্কায় পর্যটনের মতো পরিষেবাও ঘোর বেকায়দায়। এর কোনওটার হিসেবই সিএসও-র ত্রৈমাসিক পরিসংখ্যানে আসেনি। এই পরিসংখ্যানকে কতখানি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেটা আঁচ করা সম্ভব।

ঘটনা হল, যতটুকু তথ্যের ভিত্তিতে ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির হারের হিসেব পেশ করা হয়, তার ওপর নির্ভর করে অর্থনীতির ওপর নোট বদলের প্রভাব মাপা অসম্ভব। ৭% বৃদ্ধির হারের হিসেব নিয়ে তাই বিশেষ উত্তেজিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। সিএসও-র হিসেবের পদ্ধতি নিয়ে যে প্রশ্নগুলো উঠেছে, তার প্রতিটিই যথার্থ। কিন্তু, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তথ্যের জলও ঘোলা করা হয়েছিল কি না, সেই সন্দেহও থাকছে।

দিল্লিতে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন