গত বছর কলকাতা সহ রাজ্যের কয়েকটি জেলায় ডেঙ্গি ব্যাপক আকার নিয়েছিল। গত বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে এ বছরের শুরু থেকেই স্বাস্থ্য দফতরের তত্ত্বাবধানে ডেঙ্গির বাহক মশার প্রজননস্থল ও ডেঙ্গি সংক্রমণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি মশা দমন ও ডেঙ্গি প্রতিরোধের কাজ চলছে। মশা দমনের কাজে নানা প্রকৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও ডেঙ্গির সংক্রমণ ও মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিষয়টিকে পর্যালোচনা করা ও জনসচেতনতা তৈরি করাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
আমরা জানি, ডেঙ্গি একটি মশাবাহিত ভাইরাসঘটিত রোগ। ১২৮টি দেশে বসবাসকারী পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আমাদের দেশের ৩৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই রোগ ছড়িয়েছে। সরকারি হিসাবমতে, গত বছর এই রাজ্যে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৭ হাজার, যদিও বেসরকারি মতে, আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি।
ডেঙ্গি ভাইরাস সংক্রমণের ফলে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে বা নাও পারে। রোগের প্রাথমিক উপসর্গ ফ্লু-এর মতো। তবে তীব্র জ্বরের (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) সঙ্গে মাথাধরা, চোখের পিছনে, গাঁট ও মাংসপেশিতে তীব্র যন্ত্রণা, গ্ল্যান্ড ফোলা, শরীরে র্যাশ বেরনো, বমিভাব ও বমি— এগুলির যে কোনও দুটি উপসর্গ দেখা গেলে তাকে ডেঙ্গি জ্বর হিসাবে গণ্য করা হয়।
জ্বর মশা কামড়ানোর ৪-১০ দিন পর শুরু হয়ে ২-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জ্বর কমে যাওয়ার পর রোগীর অবস্থা জটিলতর হয়। রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে, প্লাজমা নিঃসরণের ফলে শরীরে তরল জমতে শুরু করে, শরীরের অভ্যন্তরের অঙ্গ ও মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে, পেটে তীব্র যন্ত্রণা, রক্তবমি, মল ও প্রস্রাবে রক্ত, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা, ক্লান্তি ও শেষে বিবিধ অঙ্গ বিকল হতে শুরু করে (ডেঙ্গি হিমারেজিক ফিভার)। সবশেষে, রক্তচাপ কমে যায় ও রক্ত সংবহন বন্ধ হয়ে যায় (শক সিনড্রোম)। এসব ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুহার খুবই বেশি।
ইতিমধ্যে এ কথাটিও বহুল চর্চিত যে, ডেঙ্গি ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ আছে। DENV-1। DENV-2। DENV-3। DENV-4। এরা সকলেই উপসর্গহীন বা উপসর্গযুক্ত সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ২০১৩ সালে মালয়েশিয়াতে ভাইরাসের পঞ্চম সেরোটাইপটি (DENV-5) চিহ্নিত হয়। তবে এটি মূলত বাঁদরজাতীয় বন্য প্রাণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই সেরোটাইপগুলির সংক্রমণ ও রোগসৃষ্টির ক্ষমতা ভিন্ন। এদের মধ্যে কোনও একটি সেরোটাইপের সংক্রমণ হলে আক্রান্ত ব্যক্তি বাকি জীবনের জন্য ওই সেরোটাইপকে প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু অন্য সেরোটাইপগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মাত্র ৩-৪ মাস স্থায়ী হয়। ফলে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ সর্বদাই অন্য সেরোটাইপ দিয়ে হয় এবং তার ফলও হয় মারাত্মক। এদিকে, আবার সেরোটাইপগুলির গঠনশৈলীতে পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সব কিছু মিলে ডেঙ্গির বিষয়টি ক্রমশ জটিলতর হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল, জ্বর হলে তা ডেঙ্গি কিনা, বোঝা যাবে কী ভাবে? ঠিক ভাবে ডেঙ্গি নির্ণয়ের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় ভুল চিকিৎসা, এমনকি প্রতারিত হওয়াও অসম্ভব নয়। তা ছাড়া ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের অন্যতম কেন্দ্রে ডেঙ্গি নির্ণয়ের পদ্ধতি। তাই এ সম্পর্কে দু’একটি কথা বলা দরকার। বিষয়টির গভীরে না ঢুকেও বলা যায়, ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হওয়ার পর পাঁচ দিন পর্যন্ত রক্তে NS1 অ্যান্টিজেন টেস্ট করা যায়। তবে র্যাপিড টেস্ট কিট নয়, এলাইজা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এর পরে হলে ইমিউনোগ্লোবিউলিন অ্যান্টিবডি (আইজিএম/আইজিজি) টেস্ট করতে হবে। রক্তে আইজিএম. অ্যান্টিবডি পাওয়া গেলে প্রথম সংক্রমণ, কিন্তু সঙ্গে আইজিজি অ্যান্টিবডি থাকলে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ।
ডেঙ্গির নিরাময় হবে কী ভাবে? প্রকৃতপক্ষে ডেঙ্গির কোনও চিকিৎসা নেই, যেমন যেমন উপসর্গ, তেমন তেমন চিকিৎসা। অবস্থা সঙ্কটজনক হলে সাপোর্ট সিস্টেম চালু রাখা। ডেঙ্গির একটি প্রতিষেধক ভ্যাকসিন ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র অনুমোদন পেয়েছে, কয়েকটি দেশে নথিভুক্ত হয়েছে। এর কার্যকারিতা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।
তা হলে বিকল্প কি? বিকল্প একটাই— । যাতে রোগ ছড়াতে না পারে।
মূলত, দু’টি প্রজাতির স্ত্রী মশা— ইডিস ইজিপ্টাই (ইয়েলো ফিভার মসকুইটো) ও ইডিস অ্যালবোপিক্টাস (টাইগার মসকুইটো) ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক। শহরে সাধারণ ভাবে ইজিপ্টাই-এর প্রাদুর্ভাব, শহরের প্রান্তে বা গ্রামাঞ্চলে অ্যালবোপিক্টাস-এর উপদ্রব বেশি। ইজিপ্টাই ঘরের মধ্যে বা বাড়ির চারিপাশে থাকে। অ্যালবোপিক্টাস মূলত বাগান, পার্ক প্রভৃতিতে বেশি থাকে। বর্তমানে অবশ্য দু’ধরনের মশারই স্বভাবে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এরা দিনের বেলা কামড়ায়। সূর্যোদয়ের পর ঘণ্টা দুই আর সূর্যাস্তের আগে কয়েক ঘণ্টা।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং পতঙ্গবিদ