হিমশিম: পুলিশের লাঠি কেড়ে মার বিক্ষোভকারীদের। মঙ্গলবার, ঢাকুরিয়ায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
অভিনন্দন, পশ্চিমবঙ্গ। সভ্যতার শেষ বাধাটিকেও অতিক্রম করিয়া গেল রাজ্যবাসী। ডাক্তারনিগ্রহ, পুলিশপ্রহার, সাংবাদিক-হেনস্থা, শিক্ষকদের জুতা প্রদর্শন পার হইয়া ঢাকুরিয়ায় এই বার শিক্ষিকার শ্লীলতাহানিও ঘটিয়া গেল। একটি পাঁচ বৎসর বয়সি ছাত্রীকে যৌননিপীড়ন করিয়াছেন এক শিক্ষক, এই অভিযোগে স্কুলে চড়াও হইলেন অভিভাবকরা, এবং আরও অনেকে। স্কুলের পরিসরেই শুধু নহে, রাস্তায়, স্টেশনে শিক্ষিকাদের দেখিলেই ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন ‘বিক্ষুব্ধ’রা। শিক্ষিকার পোশাক ছিঁড়িয়া দেওয়ার নিদান দিয়াছেন। ইহার পর কী, ভাবিবার মতো মনোবল সভ্য সমাজের থাকিবার কথা নহে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনসমাজ নিশ্চয় অতলের পরের ধাপও খুঁজিয়া পাইবে। আপত্তি করিবার উপায় থাকিবে না— জনতার ক্ষোভ শিরোধার্য। স্কুলশিক্ষক একটি শিশুকে যৌননিপীড়ন করিবেন, অথচ স্কুলে খবর দেওয়ার পর অভিভাবকরা থানায় নালিশ সারিয়া ফিরিবার মধ্যে স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত শিক্ষক-সহ সকল শিক্ষককে ফাঁসিকাঠে ঝুলাইয়া দিবেন না, তাহা হইলে জনতা ক্ষুব্ধ হইবে তো বটেই। অভিযুক্ত-সহ সকল শিক্ষককে জনতার হাতে ছাড়িয়া দিবার দাবি উঠিবে, সেই দাবি মানা না হইলে স্কুলে ভাঙচুর হইবে তো বটেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিক্ষুব্ধ জনতা বিনা শাস্তিতে পার পাইয়া যাইবে, কারণ, দুর্জনে বলিবে— তাহাদের ভোট আছে। শিক্ষিকাদের উপর চড়াও হওয়ার ঘটনাটি নূতন। কিন্তু, রাজ্য আশা করিতেই পারে, অতঃপর তাহাও স্বাভাবিক হইয়া উঠিবে।
বিশ্বাস নামক বস্তুটিকে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ কুলার বাতাস দিয়া বিদায় করিয়াছে। তাহাতে প্রশাসনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অপরাধের বিহিত করিবার পথে রাজনৈতিক রং যদি বৃহত্তম বিবেচনা হইয়া উঠে, তবে সেই সমাজে আস্থা না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু, সমাজ তো শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের নহে। মঙ্গলবার যে অভিভাবক ও বহিরাগতরা স্কুলে চড়াও হইলেন, তাঁহাদের পিছনে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক মদত ছিল বলিয়া এখনও শোনা যায় নাই। রাজনৈতিক সংস্কৃতিটি ছিল, ভরসাও ছিল যে কিছু হইবে না। কিন্তু, হাঙ্গামার সিদ্ধান্তটি সম্ভবত তাঁহাদের নিজস্ব। স্বতঃস্ফূর্ত। সাধারণ মানুষ আর নিজেদের ক্ষোভের মীমাংসায় হিংস্রতা ব্যতীত অন্য কোনও পথের কথা ভাবিতে পারে না, পাঁচ বৎসর অন্তর নির্বাচনের উৎসব পালন করা একটি দেশের পক্ষে ইহার অধিক লজ্জার আর কী হইতে পারে? আলোচনা, যুক্তি-তর্ক, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শন, কোনওটিই আর এখন জনতার নিকট মান্য পদ্ধতি নহে। মানুষ শুধু চাহেন, অভিযুক্তকে তাঁহাদের হাতে ছাড়িয়া দেওয়া হউক, বাকিটা তাঁহারাই বুঝিয়া লইবেন। পকেটমারের জন্য জনতার আদালতে যে বিচার বরাদ্দ, এখন তাহাই সর্বজনীন।
রাজনৈতিক নেতারা এই লজ্জার দায় লইবেন বলিয়া ভরসা হয় না। পুলিশ অন্তত ভাবিয়া দেখুক, তাহাদের ভূমিকা কতখানি। ধরাকরা করিবার মতো খুঁটি না থাকিলে পুলিশের নিকট অভিযোগ জানাইয়া লাভ নাই, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাসটি এখন সর্বাত্মক। কেন পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতা হিমাঙ্কের বহু নীচে, কর্তারা নিশ্চয় জানিবেন। বাহিনীর দক্ষতাও কেন তলানিতে আসিয়া ঠেকিয়াছে, বরং সেই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজুন। যেখানে বিপুল গোলমাল চলিতেছে, সেখানে শিক্ষিকাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিবে না পুলিশ? যথেষ্ট প্রস্তুত হইয়া মাঠে নামিবে না? দৃশ্যত, বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের উপরও হাতের সুখ করিয়া লইয়াছে। কারণে-অকারণে প্রহৃত হওয়া (এবং, ক্ষেত্রবিশেষে টেবিলের তলায় লুকাইয়া পড়া) যে বাহিনীর ভবিতব্য, সভ্য সমাজ তাহার উপর আস্থা রাখিবে কোন ভরসায়? এই পুলিশ কোন সমাজকে সুরক্ষা দিবে?