কুলভূষণ যাদবের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা স্থগিত করিয়া ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব ক্রিমিনাল জাস্টিস পাকিস্তানকে নির্দেশ দিয়াছে, আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার সমাপ্ত না হইলে ভারতীয় নাগরিক কুলভূষণকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাইবে না। এক ঢিলে দুই লক্ষ্যভেদ: আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারতের অবস্থান মান্যতা পাইয়াছে এবং পাকিস্তানের যুক্তিসমূহ খারিজ হইয়াছে। বিশেষত ভারতীয় নাগরিক কুলভূষণকে তাহার দেশের কনসুলেটের সহিত যোগাযোগ করিতে না দিয়া পাকিস্তান যে আন্তর্জাতিক বিধি লঙ্ঘন করিয়াছে, ভারতের এই অভিযোগ আদালত মানিয়াছে। কুলভূষণকে ঘিরিয়া বিতর্কটি ‘দ্বিপাক্ষিক বিষয়’ বলিয়া পাকিস্তানের দাবিও মানিতে যে রাজি হন নাই বিচারকেরা, ইহাতেও ভারতের জয়। ভারতের নেতা-আমলাদের স্বস্তির কারণ আরও এই যে, কুলভূষণের বিষয়টি লইয়া পাকিস্তানের সহিত মতান্তরের বিচার চাহিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়া ভারত যথেষ্ট ঝুঁকি লইয়াছিল। তাহা কেবল মামলা খারিজ হইলে অপদস্থ হইবার আশঙ্কাই নহে। সত্তরের দশকের পর হইতেই ভারত পাকিস্তানের সহিত তাহার দ্বন্দ্বগুলিকে ‘দ্বিপাক্ষিক বিষয়’ বলিয়া দাবি করিয়া আসিতেছে, এবং সে সকল প্রশ্নে আন্তর্জাতিক বিচারের প্রস্তাব খারিজ করিয়াছে। কূটনীতির ব্যাকরণমতে, বিবদমান দুই পক্ষ হিসাবে কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়াইলে পাকিস্তানের সহিত যাহাতে সমপর্যায়ে দাঁড়াইতে না হয়, সেই জন্যই এই ‘দ্বিপাক্ষিক বিষয়’ গোত্রনির্ধারণটি আপত্তিকর। ভারতের দাবি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পৃথক ও বিশিষ্ট স্থান। দ্বিতীয়ত কাশ্মীর-বিবাদকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে লইয়া যাইবার অর্থ, ভারতকে অভিযুক্তের স্থানে দাঁড়াইতে বাধ্য হওয়া। স্বভাবতই ভারত তাহাতে অনাগ্রহী।
এই কূটনৈতিক জয়ের সন্তুষ্টির মধ্যে জাতীয়তাবাদী বাড়াবাড়িটি অবশ্যই নজর এড়ায় না। আন্তর্জাতিক কূটনীতির বিভিন্ন প্রসঙ্গ ব্যবহার করিয়া জাতীয় রাজনীতি সরগরম করিতে দুই দেশের সরকারই অতি মাত্রায় ব্যগ্র। ভারতে এই স্থগিতাদেশকে ‘যুদ্ধজয়’ বলিয়া প্রচার করা হইল। কৃতিত্বের ভাগ কে কে পাইতে পারে তাহার তালিকা তৈরি হইল। দুঃখজনক। কৌতুকপ্রদও বটে। লক্ষ্যসিদ্ধি এখনও বহু দূরে। কুলভূষণের গুপ্তচরবৃত্তির প্রমাণ পেশ করিবে পাকিস্তান, তাহার খণ্ডন করিবে ভারত। এই বাদানুবাদ তিক্ত ও উত্তপ্ত হইবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। আইনজীবীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা যদি নেতারা ক্রমাগত দুইটি দেশের হার-জিতের নিরিখে দেখাইতে থাকেন, তাহা দুই দেশেই জাতীয় রাজনীতিতে সংকট তৈরি করিবে। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকার হেগ-এর আদালতে ‘পরাজয়’ লইয়া বিরোধীদের এবং নাগরিক সমাজের প্রবল চাপের মুখে পড়িয়াছে। গোটা ঘটনায় স্পষ্ট, কূটনীতি পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কেবল অপ্রয়োজনীয় নয়, বিপজ্জনকও। দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ তাহাতে লঙ্ঘিত হয়।।
সংবাদমাধ্যমের একাংশের ভূমিকাও এই প্রসঙ্গে নিন্দাযোগ্য। ভারতে বাবুর পারিষদ দলের ন্যায় তাঁহারা নেতাদের আস্ফালনকে শতগুণ বাড়াইয়া দেশবাসীকে দেখাইতেছেন। অনবরত যুদ্ধদামামা বাজাইয়া উত্তেজনাময় আবহ সৃষ্টি করিতেছেন। এই প্রবণতা নূতন নয়, কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে তাহা মাত্রাছাড়া দাঁড়াইয়াছে। পাকিস্তান অবশ্য সর্বদাই ভারতেরও উপর দিয়া যায়। কিছু দিন পূর্বেই ভারতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আব্দুল বাসিত বলিয়াছেন, সন্ত্রাস ভিন্ন আরও অনেক বিষয় রহিয়াছে, যাহা লইয়া ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলিতে পারে। দুই দেশের নানা নাগরিক সংগঠনও আবেদন করিয়াছে, ভারত-পাক কথোপকথন যেন বন্ধ না হয়। কূটনীতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা সরকারি কর্তাদের কাজ, তাঁহারাই করুন। নাগরিকরা সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার পথ হইতে সরিবেন কেন?