Uttam Kumar

গড়ে দিয়েছেন উত্তমকুমারকে

নির্মলচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন ময়মনসিংহের রসুলপুরে ১৮ অগস্ট ১৯১৮-য়। রুপোলি জগতে যোগ ছাত্রাবস্থায়।

Advertisement

আবীর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২১ ০২:৪৪
Share:

মাসিমা মালপো খামু’— প্রবাদে পরিণত হলেও, সংলাপটির রচয়িতা নির্মল দে-কে কেউ মনে রাখেনি। অথচ উত্তমকুমারের প্রথম হিট, উত্তম-সুচিত্রার প্রথম জুটি সব তাঁরই পরিচালনায়। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুরকার রূপে আত্মপ্রকাশ তাঁরই চাঁপাডাঙ্গার বৌ-তে। সত্যজিৎ রায়েরও আগে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় ক্ষমতাকে তিনিই যথাযথ পরিসর দিয়েছিলেন সাড়ে চুয়াত্তর-এ।

Advertisement

নির্মলচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন ময়মনসিংহের রসুলপুরে ১৮ অগস্ট ১৯১৮-য়। রুপোলি জগতে যোগ ছাত্রাবস্থায়। বিমল রায়ের সহযোগী চিত্রনাট্যকার ছিলেন তিনি। তখন বম্বের ‘ইস্টার্ন স্টুডিয়োজ়’-এর ছবিগুলিতে ক্যামেরার কাজও করেছেন। তারাশঙ্করের রচনা অবলম্বনে বেদেনী ছবি দিয়ে তিনি পরিচালনায় আসেন। ছবিতে ছিলেন কেতকী দত্ত, অভি ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ। কেষ্ট মুখোপাধ্যায় প্রথম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে মনোনীত হন এই ছবিতেই। নির্মলবাবুর প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। ঋত্বিক মৃণাল সেন, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, তাপস সেনদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ঋত্বিকের কিছু বন্ধুরাও বেদেনীর কাজে লেগে পড়েন। ছবি মুক্তি না পেলেও পরিচালক নির্মল দে-র সুখ্যাতি ছড়ায়।

চক্রবেড়িয়ায় মেসে থাকতেন নির্মলবাবুর অধ্যাপক মামাশ্বশুর। নির্মলবাবু সেই ঘরেই বসু পরিবার-এর চিত্রনাট্য লিখতেন। নতুন ইহুদি নাটকখ্যাত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, বাণী গঙ্গোপাধ্যায়, নেপাল নাগের মতো অভিনেতা বসু পরিবার-এর জন্য নির্বাচিত হন। স্টুডিয়োপাড়ায় উত্তম তখন ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’। বসু পরিবার-এর জন্য তিনি নির্মল দে-র কাছে প্রশিক্ষণ নিতেন। উত্তমকুমার বলেছিলেন, “শুধু আমিই না, সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়— বসু পরিবার-এর প্রত্যেকেই নির্মলদা-র কাছে ফিল্ম অ্যাক্টিং শিখেছেন।”

Advertisement

পরের ছবিটি সাড়ে চুয়াত্তর। চক্রবেড়িয়ার মেসে কেউ বারান্দায় এসে নাক ঝাড়তেন তো কেউ ‘ব্যোমকালী’ বলে হেঁকে উঠতেন। বিজন ভট্টাচার্যের কাহিনিতে এই চরিত্রগুলোকেই ঢুকিয়ে দিলেন নির্মলবাবু। ছবির রমলা চরিত্রের জন্য ভবানীপুরনিবাসী মালা সিংহকে না পেলে, মলিনা দেবীর সুপারিশে উল্টোরথ-এর সাংবাদিক বিজন দত্ত নির্মলবাবুর কাছে সুচিত্রার নাম করেন। ১৯৫৩-তে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি খুঁজে দিল বাংলা ছায়াছবির শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক জুটিকে। একগুচ্ছ চরিত্রাভিনেতাও তুলে আনল। ‘মাসিমা মালপো খামু’-র শুটিংয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরিচালকের বাড়ি থেকে আসা ২৫টা মালপোয়া খেতে হয়েছিল। বাসে যাতায়াত করতেন পারিজাত বসু, উত্তমকুমার ও নির্মল দে।

পরিচালকের তৃতীয় ছবি চাঁপাডাঙ্গার বৌ-ও সুপারহিট। দেশভাগ ও যুদ্ধোত্তর বাংলা ছায়াছবির হৃৎস্পন্দনটা তিনি ধরতে পেরেছিলেন। এক দিকে মধু বসু, দেবকী বসু, নরেশ মিত্রের মতো প্রবীণরা সচল, তেমনই অন্য দিকে বাঙালিরা তখনও সত্যজিৎ, ঋত্বিক, তপন, মৃণাল বা যাত্রিকদের চেনেনি। এই দুই প্রজন্মের মধ্যে অন্যতম সংযোগস্থাপক তিনি।

বিবেকানন্দের জন্মশতবার্ষিকীতে সরকারি অনুরোধে পরিচালনা করেন লাইফ অ্যান্ড মেসেজ অব স্বামী বিবেকানন্দ। তথ্যচিত্রটির জন্য ছবি এঁকেছিলেন রণেন আয়ান দত্ত। ইংরেজি চিত্রনাট্য লেখেন অধ্যাপক শিশির কুমার ঘোষ। সলিল চৌধুরীর সুরে গলা মেলান হেমন্ত, আশা।

ষাটের দশকে বম্বেতেই তিনি সক্রিয়তর। সেখানে চিত্রনাট্য রচনা ছাড়াও মাঝেমধ্যে অভিনয়ও করেছেন। এই ধারায় অনুসরণ করেছেন আলফ্রেড হিচকককে। সাড়ে চুয়াত্তর-এ কলকাতার রাস্তা দিয়ে যে স্যুটপরিহিত ধূমপানরত ব্যক্তিকে এক ঝলক দেখা যায় তিনি পরিচালক স্বয়ং। দিলীপকুমারের অনুরোধে রাম অউর শ্যাম-এর চিত্রনাট্য লিখেছেন, তাতে বাঙালি উকিলের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন। সেই সময়ে শাগির্দ, অভিনেত্রী, গোপী ইত্যাদি হিন্দি ছবিরও চিত্রনাট্য লিখেছেন। এ সময় দু’বার হৃদ্‌রোগের ধাক্কা সামলেছিলেন।

২৮ অক্টোবর, ১৯৬৮। কালীপুজোর দিন। কেউ জানালার কার্নিশে শব্দবাজি ফাটাল। অনেক চেষ্টাতেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। এই অকালমৃত্যুতে তাঁর বিস্মৃতির অতলে যাওয়ার শুরু।

তাঁর সাড়ে চুয়াত্তর-কে বাঙালি ভুলবে না। সত্যজিৎ রায় নির্মলবাবুর পরিচালিত প্রথম তিনটি ছবিকে সবাক যুগের প্রথম দুই দশকের ছবিগুলির মধ্যে ‘চিত্রোপযোগী গুণে’ সমৃদ্ধতম আখ্যা দেন। কিন্তু একটা ছবি হিট করলেই কিছু পরিচালক যেমন সেই বিষয়বস্তু নিয়েই পর পর ছবি করেন, নির্মলবাবু সেই প্রবণতায় বাঁধা পড়েননি। অতি অল্প ছবি করলেও, প্রতিটির বিষয়বস্তু ভিন্ন। ঋত্বিক ঘটক ছাড়াও তাঁর কাছে কাজ শিখেছেন রাজকুমারী, ছুটির ফাঁদে-র পরিচালক সলিল সেন, সদ্যপ্রয়াত রমেশ (পুনু) সেন, জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত প্রফুল্ল সেনগুপ্ত। বম্বেতে তাঁর সহকারী ছিলেন রাধু কর্মকার। তাঁর চিত্রগ্রহণ দক্ষতায় মুগ্ধ ছিলেন জদ্দনবাই।

অতুল অবদানের অনুপাতে প্রাপ্যটুকুও পাননি। শাগির্দ বাদে ওই সময়ে আর যে সব হিন্দি চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, সেগুলির পরিচয়লিপিতে নামই নেই। বাঙালির কাছেও তিনি পরিত্যক্ত, অনাদৃত। তবু নির্মল দে-র নাম বাদ দিলে বাংলা ছায়াছবির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন