অধ্যাপক অমর্ত্য সেন
এদেশের হাল হকিকত, ভালমন্দ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এ দেশে এসে চব্বিশ ঘণ্টা অষ্টপ্রহর বসবাস করতে হবে। নব্য ভারতের নতুন ফরমান পেয়েছেন বস্টন নিবাসী ভারতচিন্তায় মগ্ন সেন মহাশয়। কিসের তাড়নায় ভদ্রলোক অশক্ত শরীর নিয়েও ফি বছর অন্তত বার পাঁচেক এ দেশে আসেন পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর মাঝে? কারণটা অবশ্যই এ দেশ। তাঁরই দেশ। এ দেশের ভালমন্দ বিচার বিবেচনা করার এবং নিজের মতটা— তা যতই রাজন্য-অপ্রিয় হোক— বলার অধিকার দেশের সংবিধান তাঁকে দিয়েছে। তিনি নিয়মিত ছুটে যান গ্রাম-ভারতে। সম্যক বোঝার চেষ্টা করেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং প্রান্তিক মানুষের জীবনের হালহকিকত, প্রতিনিয়ত আলাপ আলোচনা করেন সাধারণ মানুষ থেকে শিক্ষাবিদ, সবার সঙ্গে। মহাসাগরপ্রমেয় জ্ঞানের সঙ্গে প্রখর অন্তর্দৃষ্টি মিলিয়ে লেখেন, কথা বলেন, এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ খোঁজেন।
এখানেই সমস্যা। রাজঅমাত্যের ক্রুদ্ধ ভ্রুকুটি শোনা গিয়েছে— অমর্ত্য সেনের এমনধারা আচরণ অনুচিত। অনুচিত, কারণ তিনি বিদেশে থাকেন! অর্থাৎ, জানা গেল, চিন্তার ভৌগোলিক গণ্ডি আছে, দর্শনেরও আছে কাঁটাতারের বেড়া! না, মানতেই হবে, মুখ ফুটে বলা হয়নি যে, এ দেশ গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গিদের দেশ। এখনও ওইটুকু আড়াল রাখছেন ওঁরা। কিন্তু বিরক্তি এবং বিদ্বেষটা ষোলো আনা ঠাহর করা যায়। বুঝে নেওয়া যায়, এ ফরমানে লুকিয়ে আছে রাজার অব্যক্ত গর্জন।
এই অনুশাসন জারি করার সময় রাজমুখাপেক্ষী ভদ্রলোকরা অবশ্যই অষ্টোত্তর শতনাম জপ করেন। না হলে চাকরি যাবে। যেমন গিয়েছে পূর্বসূরি জনা দুয়েক অর্থনীতির কারবারির। আর্থিক উন্নয়নের ‘গুজরাত মডেল’-এর যে ভেলায় দেশ এখন ভাসছে, তার সওয়ারি হওয়ার লিপ্সা নিয়ে যাঁরা বিদেশ থেকেই তোপ দাগতেন অধ্যাপক সেনের প্রতি। মধুচন্দ্রিমার মোহ কাটতে কারও লেগেছে বছর দুয়েক, কারও বা তারও কম। বিদেশে থেকেই এঁরা পরম অসহিষ্ণুতায় পেশির আস্ফালন করতেন, তখন অবশ্য তা দেশপ্রেমের প্রকাশ বলেই গৃহীত হত। মজার ব্যাপার, তাঁরা আবার যে যার বিদেশেই ফিরে গিয়েছেন। এবং তাঁরা সবাই এখন মোটের উপর নীরব। সরব শুধু সেই মানুষটা, যাঁর ভাবনা দৃঢ় প্রতীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
অসহিষ্ণুতার যে সামগ্রিক বাতাবরণ দেশের সামাজিক পরিমণ্ডলে তৈরি করা হয়েছে গত চার বছর ধরে, পড়াশোনা করে সরকারি প্রকোষ্ঠে ঠাঁই পাওয়া মানুষরাও যদি সেই পেশির আস্ফালন দেখান তা হলে তা দেশের পক্ষে অমঙ্গলের সূচক। পারিষদীয় উষ্মার কারণ, সেন মহাশয়ের চোখে নাকি আলো নেই। দেখতেই পান না চার বছরে আর্থিক উন্নয়নের রোশনাইতে কী ভাবে ভাসছে দেশের প্রতিটা প্রান্তর। বিশ্ব চিন্তার ক্যানভাসে এ দেশের সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্যের কারণ খুঁজে চলেন অধ্যাপক সেন। দেশের প্রগতির পক্ষে এই বৈষম্যকে এক কালান্তক ব্যাধি ও বাধা বলে মনে করেন। দারিদ্র, অপুষ্টি, অশিক্ষা, স্বাস্থ্যের দুরবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন যখনই সুযোগ পান। শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের সুযোগ সমাজের ব্যাপক অংশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যে জরুরি, সে কথা বলেন দৃঢ় প্রত্যয়ে, স্পষ্ট ভাষায়। এবং যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে বার বার জানিয়ে দেন— বাজার এ কাজ করতে পারবে না, এ কাজ করতে হবে সরকারকেই। আর তার জন্য বাড়াতে হবে সরকারি বরাদ্দ।
ওঁদের রাগটা আরও বেশি এই কারণেই। দেশের সব সম্পদ বিক্রিবাটা করে দেওয়ার একটা আয়োজন চলছে দেশ জুড়ে। কোনটা উন্নয়ন আর কোনটা অধোগমন সেটাকেই গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে সর্বতো ভাবে। না হলে কি আর পায়ু-দ্বার দিয়ে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে রোগ সারানোর পদ্ধতি সরকারি পিঠচাপড়ানি পায়? প্রবল উৎসাহে মহান ভারত খুঁজে চলেছে গোমূত্রের রোগ সারানোর ক্ষমতা, রামায়ণে ইন্টারনেটের ব্যবহার, গণেশের নাকে প্লাস্টিক সার্জারি— এ রকম আরও কত কী! এ রকম একটা সময়ে প্রমিথিউসের কণ্ঠস্বর: ‘‘গ্রেট লিপ ব্যাকওয়ার্ড।’’ ভাগ্যিস গোরক্ষকরা অনেক কাজকম্ম করার পর এখন বিশ্রামে আছেন। না হলে ভদ্রলোক টের পেতেন এ দেশে বসে এ কথা বলার ফল কী হতে পারে।
‘অ্যাকাডেমিক অ্যাক্টিভিজ়ম’-এর এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। আমাদের সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে সুরক্ষিত বলয়ের মধ্যে থেকে জ্ঞানের আলোচনার বাইরে আমাদের একটা সামাজিক দায় আছে। সততার সঙ্গে তা পালন করা দরকার সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী। সমস্যা হল, প্রথাগত শিক্ষার থেকে পাওয়া মুকুট পরে আমরা অনেকেই রাজপ্রাসাদের গ্যালারিতে থরে থরে সাজানো ‘চিড়েতন, রুইতন, ইস্কাবন’ হয়ে যাই। প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা বড় মোহময়, তাকে জয় করার জন্য নিরন্তর নিজের সঙ্গে বিতর্ক করতে হয়। অন্য দিকে বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গনে নিতান্তই নিয়ন্ত্রিত কণ্ঠস্বর শুনতে অভ্যস্ত, প্রজাতিগত ভাবে অসহিষ্ণু শাসককুল ‘অনিয়ন্ত্রিত’ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলে বড় অসহায় বোধ করেন। এটা তাঁদের কাছে ধূলিঝড়ের মতো ঠেকে, তাঁরা হয়ে যান বেসামাল। চোখ মুছে আত্মরক্ষার চেষ্টায় শুরু করেন চোখরাঙানি। তাতে ঘাবড়ে গেলে শিক্ষার প্রতি অবিচার করা হয়। প্রতি দিন সে কথাই মনে করাচ্ছেন অধ্যাপক সেন।
সহিষ্ণুতা, মুক্তচিন্তা, বিতর্ক, বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে প্রতিটা প্রশ্নের আলোচনাই সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের এবং সমাজ প্রগতির সব থেকে সুচারু পথ। সেন-বীক্ষার এই আলো আঁধারের পাখিদের সন্ত্রস্ত করেছে। রাজনীতির প্রচলিত কাদাজলের মাঠের বাইরে যে ব্যাপক পরিসর সেখানে খোলা মনে আলোচনা করলে রাজনীতি আরও সমৃদ্ধ হতে পারে, অর্থনীতিও। অধ্যাপক সেন আমাদের বার বার সেটাই স্মরণ করাচ্ছেন। কিন্তু সহমর্মী প্রজ্ঞার সেই উচ্চারণের মর্ম বোঝার ক্ষমতা রাষ্ট্রযন্ত্রীদের নেই। তাঁদের কাছে ক্ষমতার একটাই অর্থ, একটাই ব্যবহার।
গভীর উদ্বেগের কথা হল, ক্ষমতাবানের এই উৎকট অসহিষ্ণুতার প্রকাশেও দেশে, আলোড়ন দূরে থাকুক, প্রায় কোনও প্রতিবাদ নেই। অধ্যাপক সেন সম্পর্কে এমন একটি নির্বোধ এবং অন্যায় মন্তব্যও আমরা চুপচাপ মেনে নিলাম? মেনে নেব?