National news

এই উন্মত্তদের কাছ থেকে ভারতীয়ত্বের শিক্ষা নিতে হবে?

এর চেয়ে লজ্জাজনক দৃশ্য এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর কী হতে পারে!

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ০০:৩০
Share:

ঘটনার এই ছবি ছড়িয়ে পড়েছে টুইটারে।

তথাকথিত দেশভক্তির বান ডাকলে সভ্যতার দেওয়া অন্য সব শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধের আর কোনও মূল্য যে থাকে না, তা আরও এক বার প্রমাণ হল। দেশভক্তি দেখানোর নামে এক জন শিক্ষককে জানুগত হতে বাধ্য করল তাঁর ছাত্ররা। এর চেয়ে লজ্জাজনক দৃশ্য এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর কী হতে পারে!

Advertisement

জঘন্য ঘটনাটার সাক্ষী হয়েছে কর্নাটকের এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। ভারত-পাক উত্তেজনা প্রসঙ্গে এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজের মতামত সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্ত করেছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওই অধ্যাপক। তাঁর সে ব্যক্তিগত মতামত ভারত এবং পাকিস্তান জুড়ে সম্প্রতি দাপিয়ে বেড়াতে থাকা তথাকথিত দেশভক্তদের মতামতের ঠিক বিপ্রতীপে। অতএব রাতারাতি ‘দেশদ্রোহী’ ছাপ্পা লেগে গেল অধ্যাপকের গায়ে, কলেজ চত্বরে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হল কট্টরবাদী ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে।

এতেও যদি শেষ হত ঘটনা পরম্পরা, তা হলেও খুব জোরদার নিন্দা করার কিছু থাকত না। কিন্তু আগেই বলেছি, তথাকথিত দেশভক্তদের তাণ্ডব যখন চলে দেশ জুড়ে, দেশপ্রেম আর রাষ্ট্রপ্রেমের ফারাক যখন গুলিয়ে যায়, অন্ধ রাষ্ট্রপ্রেমীরা যখন উন্মত্ত হয়ে ওঠার মতো পর্যাপ্ত রসদ পেয়ে যায়, তখন এই ধরনের অনাকাঙ্খিত প্রবণতা কাঙ্খিত সীমার মধ্যে থেমে থাকতে পারে না। অতএব, ‘দেশভক্ত’ পড়ুয়াদের তীব্র কণ্ঠস্বরের প্রতি সমীহ দেখালেন কলেজ কর্তৃপক্ষ, ‘দেশদ্রোহী’ তকমা পাওয়া অধ্যাপককে বলা হল ছাত্রদের কাছে ক্ষমা চাইতে, ক্ষমপ্রার্থী অধ্যাপককে ঘিরে ধরে অসভ্যতা এবং মূল্যবোধহীনতার উন্মত্ত উল্লাস শুরু হল।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

রাজনৈতিক তথা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে নিজের মত প্রকাশের জন্য এক জন শিক্ষককে তাঁর ছাত্ররা চরম হেনস্থা এবং অবমাননার মুখে ফেলতে চাইবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ তা ঘটতে দেবেন— এ কোন সভ্যতার রীতি? করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী শিক্ষককে দেখেও ছাত্ররা নরম হবে না, তাঁকে নিলডাউন হয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে আরও বড় অবমাননা তথা হেনস্থার মুখে ফেলা হবে— এ কোন দেশের মূল্যবোধ? ভারতীয় সভ্যতা শিক্ষককে এ ভাবে অপমান করার শিক্ষা দেয় না। ভারতভূমিতে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক যে মূল্যবোধে আধারিত, সেই মূল্যবোধে এই রকম ভয়ঙ্কর দুরাচারের কোনও স্থান নেই। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের ‘ভারতীয়ত্ব’ প্রমাণ করতে যাঁরা উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন, তাঁরা যে আসলে ভারতীয়ত্বের বুনিয়াদি শিক্ষাগুলোই পাননি, এই ঘটনা তার অত্যন্ত বড় নিদর্শন। ভারতীয়ত্বকে না বুঝেই যে ভারতীয়ত্বের বড়াই চলছে, তা আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।

আরও পড়ুন: যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে পোস্ট, অধ্যাপককে নিলডাউন করিয়ে ‘শিক্ষা’ এবিভিপি-র

ভারত এবং পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এই মুহূর্তে অত্যন্ত সঙ্কটে। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ভারতে পাকিস্তান বিরোধী আক্রোশ তৈরি হওয়ারও কারণ ঘটেছে। কিন্তু সেই আক্রোশই সব বিষয়ে শেষ কথা বলবে, সেই আক্রোশই সঙ্কটের সমাধান খুঁজে নেবে, সেই আক্রোশই দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করবে , সেই আক্রোশই ভারতীয়ত্বের একমাত্র মাপকাঠি হয়ে উঠবে— এ হতেই পারে না। কোনও কিছুর মূল্যেই এই পরিস্থিতি মেনে নেওয়া বা একে প্রশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। শহিদ জওয়ানের স্ত্রী যুদ্ধের বিরুদ্ধে মতামত দিলে তাঁকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছিঁড়ে খাচ্ছে আক্রোশ! শিক্ষক যুদ্ধের বিরুদ্ধে মুখ খুললে ছাত্ররা তাঁকে অবিশ্বাস্য অপমানের মুখে ঠেলছে! এর নাম দেশপ্রেম? এটা ভারতীয়ত্ব? এখনই এ সব বন্ধ না হলে আর ক’দিন পরে আমরা কি মুখ তুলে বলতে পারব, আমরা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের বাসিন্দা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন