না বলিলেই নয়?

এ কালের সোশ্যাল মিডিয়ায় অহোরাত্র কথার প্লাবন দেখিয়া উইটগেনস্টাইনের কথা মনে পড়ে। প্রযুক্তি আধুনিক মানুষকে বাধাবন্ধহীন যোগাযোগের সুবিধা করিয়া দিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৩০
Share:

গত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক লুডউইগ উইটগেনস্টাইন লিখিয়াছিলেন, যে বিষয়ে কিছু বলা যায় না, সেই বিষয়ে নীরব থাকা উচিত। তাঁহার সম্পর্কে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। তাঁহার সহিত এক ঘণ্টা সম্পূর্ণ নীরবে পদচারণার পরে এক ছাত্র সুদীর্ঘ নৈঃশব্দ্যজনিত অস্বস্তি দূর করিতে চাহিয়া আবহাওয়া সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করিয়াছিলেন। দার্শনিক ছাত্রের উদ্দেশে বলেন: কথা না বলিলেই কি নয়, চুপ করিয়া থাকিতে পারো না? এ কালের সোশ্যাল মিডিয়ায় অহোরাত্র কথার প্লাবন দেখিয়া উইটগেনস্টাইনের কথা মনে পড়ে। প্রযুক্তি আধুনিক মানুষকে বাধাবন্ধহীন যোগাযোগের সুবিধা করিয়া দিয়াছে। একই সঙ্গে যত জনের সঙ্গে খুশি যথেচ্ছ আলাপের, উঠিতে বসিতে চলিতে ফিরিতে সর্ব ক্ষণ ভাববিনিময়ের, নিজের কথা অপরকে শুনাইবার ও অপরের কথার পিঠে নিজের কথা জানাইবার এই অনন্ত সুযোগ কয়েক বছর আগেও কল্পনাতীত ছিল। অতএব সমাজমাধ্যমের তেপান্তরে এখন অগণিত শব্দ এবং ছবির অবিরত চলাচল। উইটগেনস্টাইনের প্রয়োজন নাই, এই ভাবোচ্ছ্বাসের প্রতি দুই দণ্ড নজর করিলে সাধারণ বুদ্ধিই একটি সংশয়ের জন্ম দেয়— যাঁহারা যে কোনও বিষয়ে এমন অনর্গল কথা বলিয়া চলিয়াছেন, তাঁহাদের নিজের কি অর্থবহ কিছুই বলিবার নাই? থাকিলে, এত বিষয়ে এত অসার কথার চর্বিতচর্বণ না করিয়া দুই দণ্ড ভাবা অনুশীলন করিতেন না কি?

Advertisement

তর্ক উঠিবে: কথার উপর তো ট্যাক্স নাই, অতিকথনে ক্ষতি কী? ক্ষতি এক নহে, একাধিক। প্রথমত, বিভিন্ন বিষয়ে অনেক মানুষের ভাবনা ও মতামতের লেনদেনের যে সুযোগ সমাজমাধ্যম তৈয়ারি করিয়া দিয়াছে, অতিকথনের তোড়ে তাহা ভাসিয়া যাইতেছে। ‘গ্রেশাম’স ল মোতাবেক খারাপ টাকা কী ভাবে ভাল টাকাকে বিতাড়ন করে সে তত্ত্ব সুবিদিত, বাজে কথার দাপটে কাজের কথা কী ভাবে বিতাড়িত হয় সেই অভিজ্ঞতাও সুলভ— চায়ের পেয়ালায় উচ্ছ্বসিত সান্ধ্য তুফান হইতে শুরু করিয়া টেলিভিশন চ্যানেলের সান্ধ্য আড্ডা, সর্বত্র তাহার নিত্য প্রদর্শনী। সমাজমাধ্যম সেই অভিজ্ঞতাকে নূতন মাত্রা দিয়াছে। অকাজের কথা প্রতিনিয়ত সহস্রধারে উৎসারিত হইতেছে, কেহ কোনও কাজের কথা তুলিলেও, কোনও গুরুতর বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করিলেও প্রায়শই অসার মন্তব্য, টিপ্পনী, এমনকি কটুকাটব্য হা রে রে রে করিয়া ছুটিয়া আসে, মতপার্থক্য সহজেই ব্যক্তিগত আক্রমণে পর্যবসিত হয়। যাঁহার সত্যই কিছু বলিবার আছে, তিনি সন্ত্রস্ত নীরবতার শরণাপন্ন হন। ক্ষতি নহে?

এই ক্ষতির এক গভীরতর মাত্রা আছে। আধুনিক গণতন্ত্রের প্রসারে সমাজমাধ্যমের ভূমিকা সম্ভাবনাময়। গণতন্ত্র কেবল থাকিয়া থাকিয়া ভোটের বোতাম টিপিবার ব্রত পালন নহে, নাগরিকরা মতবিনিময় করিবেন, ক্ষমতাবানদের নিকট বিবিধ দাবি পেশ করিবেন, গণতান্ত্রিক শাসকের নীতিনির্ধারণে তাঁহাদের মতামতের ভূমিকা থাকিবে, এই সকলই সতেজ সবল গণতন্ত্রের আবশ্যিক ধর্ম। কিন্তু সমস্যা হইল, প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রে কিংবা অতীত ভারতবর্ষের জনপদে এই ধরনের ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ সম্ভবপর হইলেও এই কালের বৃহৎ রাষ্ট্রে তাহার প্রয়োগসম্ভাবনা এই যাবৎ নিতান্ত সীমিত ছিল, প্রতিনিধি-নির্ভর পরোক্ষ গণতন্ত্র দিয়া কাজ চালাইতে হইত। এই শতাব্দীর প্রত্যুষে সমাজমাধ্যমের প্রবল আবির্ভাব ও অকল্পনীয় বিস্তার দেখিয়া অনেকেই কলরব করিয়া বলিয়াছিলেন: এই বার প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অনুশীলনের বাধা কাটিবে, স্থান ও সময়ের বাধা অতিক্রম করিয়া যে কোনও মানুষ অল্প খরচে তৎক্ষণাৎ পারস্পরিক যোগাযোগ করিতে পারিবে, জনগণের শাসন সত্যই জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা চালিত হইতে পারিবে, শাসকরা নাগরিকের কথা শুনিতে বাধ্য হইবেন। অল্প সময়েই এই আশার উচ্ছ্বাস স্তিমিত, অনেকাংশে বিলীন। পরিবর্তে আশঙ্কা: সমাজমাধ্যমের তাড়নায় গণতন্ত্র আমূল বিপন্ন হইবে না তো! ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন হইতে শুরু করিয়া ভারতে যত্রতত্র প্রাণঘাতী গণ-উন্মাদনা— সমাজমাধ্যম ও যোগাযোগ-প্রযুক্তির বিষম অবদান প্রকট। কিন্তু এই প্রকট রূপটির অন্তরালে থাকিয়া তাহাকে শক্তি সরবরাহ করিতেছে যে মানসিকতা, তাহা আরও বিপজ্জনক। সেই মানসিকতা কোনও বিষয়ে গভীর চিন্তায় রাজি নহে। সমাজমাধ্যম এই মানসিকতাকে লালন করিতেছে, তাহাকে নিরন্তর আত্মপ্রচারের সুযোগ করিয়া দিতেছে। এই গণ-উচ্ছ্বাস গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ হইতে পারে না।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন