কার সঙ্গে, কার বিকাশ

এক দিকে প্রদীপের রোশনাই, অন্য দিকে কেবলই অন্ধকার

স্ট্যান্ডে পাওয়া গেল এক বৃদ্ধ অটোওয়ালাকে। সাদা কুর্তা-পাজামা, একগাল দাড়ি, গোঁফ কামানো, মাথায় টুপি। জানালেন, সিদি সইদের মসজিদে পৌঁছে দেবেন ত্রিশ টাকার বিনিময়ে। অটো চলতে শুরু করল। সঙ্গে প্রশ্নও।

Advertisement

আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

আলো-আঁধারি: সিদি সইদ মসজিদের জানালায় জাফরির নকশা, ঐতিহ্যবাহী আমদাবাদ শহরের প্রতীক হিসেবে যার পরিচয়

গাঁধীনগরবাসী আত্মীয়েরা বলে দিয়েছিলেন, আমদাবাদ ঘুরতে গেলে প্রথমেই দেখতে হবে সিদি সইদ কি জালি। সেই মতো ট্যাক্সি ডাকা হল। কিন্তু গুগল ম্যাপ গাড়িসুদ্ধ জলে নামিয়ে দিতে পারে, এ-ও অজানা নয়। ফলে ঐতিহাসিক শহরটির প্রাণকেন্দ্রের বদলে নিয়ে ফেলল এক এঁদো পাড়ায়। নাম জামালপুর। এ-গলি, ও-গলি হাঁটতে হাঁটতে চলতে লাগল ঐতিহাসিক সৌধের খোঁজ। অঞ্চলের চেহারা দেখে মনে হল, সে সব থাকা অসম্ভব। একটা দরগা অবশ্য চোখে পড়ল। ও-দিকে পর পর স্কুল। তবে সেগুলোর এত দৈন্যদশা কেন? সে কথা ভাবার অবকাশ নেই তখন। অবশেষে এক স্থানীয়কে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সিদি সইদ না কি অনেক দূর। সেখানে পৌঁছতে গেলে অটো কিংবা বাস ধরতে হবে।

Advertisement

স্ট্যান্ডে পাওয়া গেল এক বৃদ্ধ অটোওয়ালাকে। সাদা কুর্তা-পাজামা, একগাল দাড়ি, গোঁফ কামানো, মাথায় টুপি। জানালেন, সিদি সইদের মসজিদে পৌঁছে দেবেন ত্রিশ টাকার বিনিময়ে। অটো চলতে শুরু করল। সঙ্গে প্রশ্নও। তিনি জানলেন, আমি বাঙালি, কলকাতাবাসী, টুরিস্ট। জানতে চাইলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর জ্যোতি বসুর মধ্যে মানুষের জন্য বেশি কাজ করেছেন কোন জন। তার পরের প্রশ্নগুলোর জন্য অবশ্য প্রস্তুত ছিলাম না।

“আপনার কাস্ট কী?”

Advertisement

“সে তো জানি না!”

“আপনি হিন্দু?”

“তা বলতে পারেন।”

“তা হলে এখানে কেন?”

“এখানে মানে?”

“মুসলমান পাড়ায় কেন? এখানে স্বামীনারায়ণের বিখ্যাত মন্দির আছে। আর ওই সামনেই দেখুন জগন্নাথ মন্দির! পুরীতে যেমন, এখানেও তেমন। চলুন, পুজো দেবেন।”

প্রায় অটো থামিয়েই দিচ্ছিলেন। একটু কড়া করেই বারণ করতে হল। প্রশ্ন তবু থামে না— “মসজিদ দেখতে এসেছেন কেন?”

এ বার স্পষ্ট জবাব দিতে বাধ্য হলাম, “আমি টুরিস্ট। আমদাবাদ হিস্টোরিক সিটির কথা অনেক পড়েছি। তাই।”

অটোচালকের উৎসাহে অবশ্য ভাটা পড়ল না। টুরিস্টের ধরনটি তিনি বুঝে গিয়েছেন, কাজেই মন দিয়ে ইসলামি সংস্কৃতির আনাচ-কানাচ চেনাতে শুরু করলেন। বড় রাস্তা ধরে যেতে যেতেই তিনি দেখালেন, পাশে বিরাট উঁচু প্রাকার। অনেকটা এলাকা জুড়ে। আমদাবাদ শহর না কি এমনই এক প্রাকারে ঘেরা। যাতায়াতের জন্য সব মিলিয়ে বারোটা দরজা রয়েছে। সংখ্যাটা মতান্তরে ষোলো এবং একুশ। এর মধ্যে আটটা দরজা ভদ্রা দুর্গের। গুজরাতের সুলতানদের সদর দফতর ছিল এটি। লোকমুখে শোনা যায়, ‘ভদ্রা’ নামের উৎস না কি লক্ষ্মীর অবতার ভদ্রকালীর নাম থেকে। মরাঠা শাসনের কালে, দুর্গের উত্তর দিকে আজ়ম খান সরাই-এর একটি ঘরকে, এই দেবীর মন্দিরে পরিণত করা হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে, এক রাতে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য দুর্গের দরজায় এসে পৌঁছেছিলেন দেবী লক্ষ্মী। প্রহরী সিদ্দিক কোতোয়াল তাঁকে চিনতে পেরে পথ আটকান। জানান, রাজার হুকুম না পেলে দেবী বেরোতে পারবেন না। হুকুম যাতে না আসে, সে জন্য নিজেই নিজের শিরশ্ছেদ করেন কোতোয়াল। ফলে শহর ছাড়েন না দৌলতের দেবী লক্ষ্মী। দৌলতও ছাড়ে না আহমদ শাহের রাজধানীকে। দুর্গের প্রধান দরজার পাশেই কোতোয়ালের কবরস্থান, পাশে ভদ্রকালীর মন্দির। আর একটু দূরে যে তিন দরওয়াজা পেরিয়ে দুর্গে পৌঁছতে হয়, সেখানে দেবী লক্ষ্মীর উদ্দেশে প্রদীপ জ্বলে। টানা ছ’শো বছর ধরে কাজটি করে চলেছে এক মুসলমান পরিবার।

সবই প্রচলিত গল্প, শুনতে বড় ভাল লাগছিল। ইতিমধ্যে সিদি সইদের মসজিদ এসে পড়ল। ভাড়া চুকিয়ে নেমে পড়লাম। আরও ভাল গল্প পাওয়া গেল সেখানে। গুজরাতের শেষ সুলতান তৃতীয় শামস-উদ-দীন মুজফ্‌ফর শাহের আমলে এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন সিদি সইদ। মসজিদের সামনে-পিছনে দশটি জাফরির কাজ করা জানালাই এর বৈশিষ্ট্য। এই কাজে ফুটে ওঠে বহুপত্রী এক গাছের নকশা। সেই নকশা এতই সুন্দর যে আমদাবাদের শহরের চিহ্ন হিসেবে সেটাকে তুলে ধরেন অনেকেই। বন্দোবস্তটা ঠিক সরকারি নয়। কিন্তু হাওড়া ব্রিজ কিংবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছবি দেখলেই যেমন কলকাতা চেনা যায়, তেমনই সিদি সইদ মসজিদের জালি দেখলেই চেনা যায় আমদাবাদকে। আইআইএম আমদাবাদের লোগো-ও ওই জালির দ্বারা অনুপ্রাণিত।

সেখান থেকে পায়ে হেঁটে এগোতে থাকলে একে একে আসে ভদ্রা দুর্গ, তিন দরওয়াজ়া, শাহি জামা মসজিদ, রানি নো হাজিরো। এ সব নিয়েই তৈরি হয়েছে প্রাচীন আমদাবাদ শহর। ১৪১১ সালে প্রথম আহমদ শাহের আমলে এর প্রতিষ্ঠা। গত বছর জুলাই মাসে তার গায়ে লেগেছে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা। পুরো শহরটা ঘুরে দেখার জন্য ‘হেরিটেজ ওয়াক’-এর ব্যবস্থা করেছে আমদাবাদ পুরসভা। তবু এ বারে আমদাবাদের অমলিন গল্পে কালচে ছোপ পড়তে শুরু করে।

আসলে, এই সব জায়গায় অযত্নই চোখে পড়ে বেশি। আহমদ শাহের রানিদের সমাধি রয়েছে রানি নো হাজিরোয়। বাজার আর ঝুপড়ির ফাঁক দিয়ে সেই স্মৃতিসৌধকে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। সৌধের ছবি তুলতে গিয়ে সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি হল কিছু অস্থায়ী দোকানঘর! ভিতরে গিয়ে দেখা গেল ধুলো জমেছে। একটা বিড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আর খোপে খোপে পায়রা। সৌধের দালান পর্যন্ত ত্রিপল বেঁধে দোকান বসেছে। আর দালানে রাখা হয়েছে, কিছু বিজেপির পতাকা।

অটোচালকের গল্প শুনতে শুনতে প্রাকারের ফাঁক দিয়ে একটু একটু চোখে পড়ছিল পাড়াগুলো। এত আবর্জনার স্তূপ দেখে কিঞ্চিৎ বিস্ময়ই জেগেছিল। এর মধ্যে মানুষ থাকেন কী করে? উত্তর অবশ্য জানা-ই: বাধ্য হয়ে। মনে পড়ে, টিনটিন সিরিজ়ের ‘পান্না কোথায়’ কাহিনিতে প্রাসাদোপম মার্লিনস্পাইক হল-এর মালিক ক্যাপ্টেন হ্যাডক এমন জিপসিদের থাকার জায়গা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করায় এক জিপসি তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, “তোমার কী ধারণা... নোংরার মধ্যে থাকতে খুব মজা লাগে আমাদের?”

হয়তো কোনও ভয়ের ইঙ্গিতও ছিল অটোচালকের প্রাথমিক প্রশ্নমালাতে। হয়তো সে জন্যই হিন্দু টুরিস্টকে ইসলামি ঐতিহ্য দেখাতে আপত্তি ছিল তাঁর। হয়তো এ রকম কেউ দেখতে চাইতে পারে, ভাবেননি তিনি।

সেই ২০১৪ সাল থেকেই গোটা দেশের জনমানসে ছেয়ে আছে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর বিপুল মোহ। বাস্তবে ঐতিহ্যের অস্বীকৃতিতে ভ্রান্ত বলে মনে হয় সেই বিজ্ঞাপন। সেই বিজ্ঞাপনে প্রাচীন আমদাবাদ শহরের এমন সমৃদ্ধ সম্পন্ন ইতিহাস কিন্তু পর্যটনের সব চেয়ে বড় উপকরণ হতেই পারত। গুজরাতি থালি আদ্যন্ত নিরামিষ, অথচ ওই যে বাজার এলাকা— যার নাম মানেক চক— সেখানে রাত হতেই মেলে বাহারি কাবাব। আজকের দিনে এমন বৈচিত্র কোথায়ই বা? তবু বেশ অনেক বছর ধরেই শাসক হাঁটছে উল্টো পথে। একাদশ শতকে চৌলুক্য রাজা কর্ণের আমলে রাজধানী শহরটির নাম হয়েছিল কর্ণাবতী। সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠার পর আহমদ শাহের নামে রাজধানীর নাম হয় আমদাবাদ। এ বার জানলাম, ফের সেই কর্ণাবতী নামেই আশ্রয় নিতে চাইছে গুজরাত।

বাস্তবটা যেন একেবারে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে। গাঁধীনগরের রাস্তাগুলো মাখনের মতো মসৃণ। নামীদামি গাড়ির শো-রুম, শপিং মল, অ্যাপার্টমেন্ট। গরিব মানুষের দেখা মেলে না তেমন। একদম সত্যি। তেমনই সত্যি তার ২০ কিলোমিটার দূরে হেরিটেজ সিটির ভাঙাচোরা গলি। এক দিকে সত্যি সাবরমতী নদীর দু’পাড়ের সৌন্দর্যায়ন। অন্য দিকে সত্যি নদীর পাশের আবর্জনাময় বস্তি। এক দিকে গাঁধীনগরের সরগাসন, কুডাসন, রাঁদেসন-এর মতো অভিজাত পাড়া, অন্য দিকে অনুন্নত জামালপুর, চমনপুরা। সেই চমনপুরা, যেখানে রয়েছে গুলবার্গ সোসাইটি, থাকতেন এহসান জাফরি। ‘লিস্‌নিং টু গ্রাসহপার্স’ বইয়ে গণতন্ত্রের কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে এ সব অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলেছিলেন অরুন্ধতী রায়। দুই দিকের মধ্যে প্রবল বৈপরীত্য। প্রথমটায় প্রদীপের রোশনাই। দ্বিতীয়টা তার নীচে, কেবলই অন্ধকার।

‘গুজরাত মডেল’-এ বাস্তবের এই অন্ধকারের দিকটাকে চেপে রাখাটাই হল দস্তুর। শোনা যায়, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজ়ো আবে-র গুজরাত সফরের সময় শহরের নানা জায়গায় সবুজ পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার আড়ালে ছিল আমদাবাদের বস্তিগুলো। অর্থাৎ শাসকের গুজরাত ততটাই, যতটা বিকশিত, নির্দিষ্ট প্রকল্পে যাকে বিকশিত করা হয়েছে। বাকিটা অস্তিত্বহীন!

চার বছর ধরে মন্ত্র শুনছি ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’। দেখেশুনে প্রশ্ন ওঠে, কার সঙ্গে? কার বিকাশ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন