উনি না আসার সিদ্ধান্ত নিলেই ভারতের মঙ্গল

তিনটি ঘটনার উল্লেখ করি। তিন জায়গাতেই ট্রাম্পের উপস্থিতির পর ভয়ানক সব কাণ্ড ঘটেছে। এক, আমেরিকা। দুই, সৌদি আরব। তিন, পোল্যান্ড।

Advertisement

ভাস্কর চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share:

আমন্ত্রণ: জার্মানিতে জি-২০ শীর্ষ বৈঠকে গিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সখ্যস্থাপনে ব্যস্ত, ৮ জুলাই। ছবি: এপি।

প্রধানমন্ত্রী মোদী ওয়াশিংটন ডি সি গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সপরিবার ভারতে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছেন। ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্পকেই নাকি এ বার ভারতের বিশ্ব উদ্যোগ শীর্ষ বৈঠকের প্রধান করে নিয়ে আসা হবে। তা, ইভাঙ্কা আসুন, বাবা ট্রাম্প যদি না আসার সিদ্ধান্ত নেন, ভারত নামক দেশটি বাঁচে।

Advertisement

কারণ? কারণ, দেখা যাচ্ছে, বাবা ট্রাম্প যেখানেই যান, সর্বত্রই কী-সব অদ্ভুত কাণ্ড ঘটতে থাকে। উদার গণতন্ত্র, সহিষ্ণু সংস্কৃতির উপর আজকাল যে সব আক্রমণ, ট্রাম্প যাওয়ার পর প্রতিটি জায়গাতেই সেই আক্রমণ মন্দ থেকে মন্দতর হয়। ট্রাম্পকে দেখার পর রক্ষণশীল উন্মাদরা কেন যেন উন্মাদতর হয়ে পড়ে! ভারতও আজকাল অসহিষ্ণুতার কেটলিতে টগবগ করে ফুটছে, কে জানে বাবা ট্রাম্প আসার পর কী ঘটবে!

তিনটি ঘটনার উল্লেখ করি। তিন জায়গাতেই ট্রাম্পের উপস্থিতির পর ভয়ানক সব কাণ্ড ঘটেছে। এক, আমেরিকা। দুই, সৌদি আরব। তিন, পোল্যান্ড। তিন দেশেই অবশ্য ট্রাম্প অবতীর্ণ হওয়ার আগেই উদারপন্থার বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু হয়।

Advertisement

ট্রাম্পের স্লোগান ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ দিয়েই শুরু করা যাক। সাম্প্রতিক কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের অশান্তি আর সংঘর্ষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। জাতিবিদ্বেষ, ইসলামবিরোধিতা। প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় থেকেই টের পেতে শুরু করেছি। এমন সময়ে আবির্ভাব হল ট্রাম্পের। তাঁর নির্বাচনী প্রচারসভা যেন মার্কিন সমাজের ভেতরে লুকোনো হিংস্র প্রাণীগুলিকে খোলা হাওয়ায় ছেড়ে দিল। ঘৃণাপূর্ণ কথাবার্তা কাজকর্ম ট্রাম্পের সভাগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াল। সামাজিক অসহিষ্ণুতার যে কত রকম ঘটনা আমেরিকায় ঘটল, তার ইয়ত্তা নেই। ট্রাম্পের নিজের শহর নিউ ইয়র্কের কথাই ধরা যাক। চির কাল লোকে জানে, নিউ ইয়র্ক হল সেই গল্পে-পড়া ‘মেল্টিং পট’, যেখানে সংস্কারের পাশাপাশি সহিষ্ণুতা এমন ভাবেই থাকে যাতে সব মিলিয়ে বেশ একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। বাকি আমেরিকার থেকে নিউ ইয়র্ক অনেক আলাদা। তবু এই শহরের মেজাজ-মরজি দিয়ে আমেরিকার সামগ্রিক পরিস্থিতির একটা পরিমাপ করা হয়ে এসেছে এত কাল। অথচ এই নভেম্বরে নিউ ইয়র্কের নাগরিক ট্রাম্প যখন নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট হলেন, নিউ ইয়র্কের পুলিশ কমিশনার জানালেন, সেই শহরের হেট-ক্রাইম বা হিংসাত্মক-অপরাধের সংখ্যা গত বছরের থেকে প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। ওই শহরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে, আর ইহুদিবিরোধী অপরাধ এক ধাক্কায় ৯ শতাংশ বেড়েছে।

ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে যদি ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ করে নভেম্বর থেকে জানুয়ারিতে চলে আসি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই সময়ে পুরোপুরি দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। প্রথম বিদেশ সফরের জন্য তিনি বেছে নিলেন: সৌদি আরবকে। সফরের গোটাটাই ছিল বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ। একটা উৎসব উৎসব ভাব, আরবের প্রাচীন ঐতিহ্যময় তলোয়ার নৃত্যে পর্যন্ত ট্রাম্প অংশ নিলেন, যদিও ঠিকঠাক নেচে উঠতে পারলেন না। কিন্তু তার পরই দেখা গেল যত গোলমাল। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইয়েমেন, বাহরিন ইত্যাদি ওই অঞ্চলের আরও অনেক দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সৌদি আরব উঠে-পড়ে লাগল কাতারকে বয়কট করতে। এমন একটা কূটনৈতিক পদক্ষেপের ফলে গোটা পশ্চিম এশিয়াই একটা সংকটের মধ্যে পড়ল, অথচ এমনিতেই সংকটদীর্ণ এই অঞ্চলে আর একটা নতুন সমস্যা তৈরি করার কোনও প্রয়োজন ছিল না! সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বিদেশমন্ত্রী পরে স্বীকার করেছেন যে ট্রাম্পের সফরের ফলেই এই আকস্মিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, অন্য কোনও কারণ নেই। ট্রাম্পও পরে টুইট করলেন: ‘কয়েক দিন আগে মধ্য প্রাচ্য সফরে গিয়ে আমি বলেছিলাম, উগ্র মৌলবাদকে কোনও আর্থিক সমর্থন নয়। ওখানকার নেতারাই তখন আঙুল তুললেন— কাতারের দিকে!’

আবার ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ করে এগোনো যাক। কাতার সংকটের পর এক মাস কেটে গিয়েছে। বিশ্বের অন্য প্রান্তে অন্য একটি দেশে এসেছেন ট্রাম্প। পোল্যান্ডে ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির নেতা জারোস্ল কাজিনস্কির কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভূয়সী প্রশংসা করে রাজধানী ওয়ারস’র ঐতিহ্যময় ক্র্যজিনস্কি স্কোয়্যারে বক্তৃতা দিলেন ট্রাম্প। পৃথিবীর সর্বত্র যত ‘বর্বর’ মানুষজন, সকলের বিরুদ্ধে ‘পশ্চিমি’ দেশগুলোর সংগ্রাম ঘোষণা করলেন। আর তার পরই দেখা গেল সে দেশের নেতারা এগিয়ে এসে একটা নতুন আইন পাশ করলেন, যে আইনে পোল্যান্ডের বিচারবিভাগের উপর রাজনীতিকদের দৃঢ় ক্ষমতা স্থাপিত হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদেরও পদ ছেড়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হবে, কে দায়িত্বে থাকবেন আর কে থাকবেন না, মন্ত্রীই ঠিক করবেন। নিম্ন আদালতগুলির ক্ষেত্রেও তাই। কোথা থেকে এত বড় একটা রক্ষণশীল সংস্কার হঠাৎ করে ঘটে গেল? আবারও সেই এক উত্তর: ট্রাম্পের আগমন এবং ও দেশের শাসক দলের প্রতি তাঁর অপরিসীম আস্থার প্রকাশই এই আকস্মিক পট-পরিবর্তনের কারণ!

এ বার ভারতের কথায় আসা যাক। ভারতের অবস্থা ভাল নয় একদম। আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে ভারত নিয়ে এখন যে সব হেডিং, তাতে ‘অবিশ্বাস্য ভারত’ বা ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র বদলে আজ ‘অখাদ্য ভারত’, ‘ইনএডিবল ইন্ডিয়া’র চিহ্ন। অথচ কিছু দিন আগেও বাইরের দুনিয়ায় খবর হত ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির বিরাট সম্ভাবনা, সত্তর বছরের ইতিহাসে নানা সামাজিক কৃতিত্ব। আর এখন? সব কিছু বাদ হয়ে এখন খবর কেবল গোরক্ষকদের তাণ্ডব, মুসলিমদের উপর গণপিটুনি ও গণনিধন। মোদীর জমানায় গরুকে কেন্দ্র করে মানুষ পেটানো বা মারার ঘটনার সংখ্যা কম করেও ষাট ছাড়িয়েছে! প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কেবল সামান্য মৌখিক প্রতিক্রিয়া, আর প্রধানমন্ত্রীর স্বহস্তনির্বাচিত উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের পক্ষ থেকে ঘোষণা: ‘ভারতের ১৭ কোটি মুসলমান নাগরিক হল এমন এক দ্বিপদবিশিষ্ট বাহিনী যাকে দ্রুত শায়েস্তা করা দরকার।’

বাক্‌স্বাধীনতা এ দেশে আর একটি অতি বিপন্ন বস্তু। প্রচারমাধ্যমের উপর চলছে সরকারি রেড, কেননা তারা নাকি ব্যাংকের ধার মেটায়নি! অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-এর উপর তথ্যচিত্র ‘দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’-এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল, কেননা তাতে নাকি ‘গরু’ এবং ‘গুজরাত’-এর মতো ভয়ানক সব শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। না, তাই বলে সব রকম মন্তব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে না! বিজেপি সাংসদ ও বলিউডের অভিনেতা পরেশ রাওয়াল যখন বললেন, হিন্দুত্ববাদের মহাশত্রু লেখক অরুন্ধতী রায়কে জিপের বনেটে বেঁধে দেওয়া হোক, তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি!

আর ছোটখাটো আক্রমণ তো আজকাল ভারতীয় সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তব। আদিত্যনাথের অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াডের কথাই ধরা যাক। তাদের দাবি, বিবাহিত দম্পতি ছাড়া কেউ হোটেলে থাকতে পারবে না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, জাতীয় হাইওয়ের ৫০০ মিটারের মধ্যে মদ বিক্রি করা যাবে না। এর আওতায় পড়ে বেঙ্গালুরু শহরের বিখ্যাত পাব-লাইফও এখন ইতিহাস।

ভারতের সমাজে এ সব হয়তো পুরো নতুন নয়। অসহিষ্ণুতা উপমহাদেশের জটিল ইতিহাসেরই অংশ। সরকারি ভাবে ধর্মনিরপক্ষ গণতন্ত্র হলেও ভারতের সমাজ প্রথম থেকেই যথেষ্ট অস্থির। অসহিষ্ণুতা সম্প্রতি তার ‘নর্মাল’ অবস্থান। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে ট্রাম্প মশাই এসে লাল কেল্লা থেকে যদি বক্তৃতা দেন, কী দাঁড়াবে? ধরা যাক, যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে বিশাল ভিড় জমা হয়ে হইহই করে সেই বক্তৃতা শুনছে, আর ত্রিশূল নিয়ে নাচছে, কেমন হবে ব্যাপারটা?

না, ট্রাম্প এ দেশে না এলেই পারেন। মেয়ে ইভাঙ্কা এলেই যথেষ্ট।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল-এ অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন