—ফাইল চিত্র।
দীর্ঘ লকডাউনে স্কুলছুটের সংখ্যা বাড়িবে, আশঙ্কা ছিলই। আশঙ্কা যে অমূলক নহে, ইংরেজবাজারের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রটিই তাহার প্রমাণ। ছাত্রটির স্মার্টফোন নাই। সুতরাং, তাহার পড়াশোনা বন্ধ হইয়াছে। অভাবের সংসারে কিছু আর্থিক সুরাহার খোঁজে সে এখন সাইকেল লইয়া আনারস ফেরি করে। ছাত্রটি একা নহে, অতিমারি-পর্বে বহু পড়ুয়া, যাহারা ‘ভার্চুয়াল’ শিক্ষার সুযোগ লইতে পারে নাই, তাহারা কেহ মাছ-সবজি বিক্রি করিয়া, কেহ জুতা সেলাই করিয়া পরিবারকে সাহায্য করিয়াছে। বস্তুত, কোভিড-১৯’এর যে আঘাত শিক্ষার উপর আসিয়াছে, তাহা অভূতপূর্ব। নূতন শিক্ষাবর্ষের অর্ধেক পার হইল, অথচ এক বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নূতন শ্রেণির পাঠ শুরুই করিতে পারিল না। কবে শুরু করিবে, সেই প্রশ্নটিও আপাতত কালের গর্ভে বিলীন। এই ক্ষতি অপূরণীয় এবং বহুমাত্রিক। ইহা শুধুমাত্র যে সমাজের একটি শ্রেণি করোনা-কালে কিছু কম লেখাপড়া শিখিল, তাহা নহে; আশঙ্কা করা হইতেছে, এই স্কুলছুটদের এক বৃহৎ অংশই হয়তো আর কখনও শিক্ষার মূলস্রোতে ফিরিবে না। অর্থাৎ, সর্বশিক্ষা অভিযান, শিক্ষার অধিকার আইন, মিড-ডে মিল প্রকল্পের হাত ধরিয়া বহু অর্থব্যয়ে এবং পরিশ্রমে যেটুকু লাভ হইয়াছিল, অতিমারি মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তাহাকে বহু পিছাইয়া দিল।
শিক্ষার এমন বেহাল দশার মূল কারণ, সরকারি স্তরে পরিকল্পনার নিদারুণ অভাব। দীর্ঘ কাল স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকিলে সর্বস্তরের পড়ুয়াদের শিক্ষাব্যবস্থাটি কী রূপে পরিচালনা করিতে হইবে, তাহা লইয়া কেন্দ্র, রাজ্য— কোনও পর্যায়েই এক সুসংহত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় নাই। যখন যেমন অভিযোগ আসিয়াছে, সেই রূপ ব্যবস্থা করা হইয়াছে। জোর দেওয়া হইয়াছে অনলাইন শিক্ষার উপর। কিন্তু এই অনলাইন শিক্ষাকে কেন্দ্র করিয়াই শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিভাজন স্পষ্ট। ডিজিটাল বিভাজন। যাহারা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ডেটাপ্যাকের দাক্ষিণ্য পাইল, তাহাদের শিক্ষা অব্যাহত থাকিল। যাহারা সেই আলোকবৃত্তে পড়িল না, তাহাদের পড়াশোনা বন্ধ হইতে বসিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র পরিবারে, যেখানে স্মার্টফোন, টিভি, কেব্ল পরিষেবা— কোনও কিছুরই ব্যবস্থা নাই, সেখানে পড়াশোনা চলিবে কী উপায়ে, আজ অবধি তাহার কোনও উত্তর মিলে নাই। কিছু ক্ষেত্রে মিড-ডে মিলের সঙ্গে কর্মপত্র বণ্টন করা হইয়াছে বটে, কিন্তু প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের সেই কার্যে সাহায্য করিবে কে?
সর্বাপেক্ষা অবহেলিত বোধ হয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের অধীন শিশুশিক্ষা কেন্দ্রগুলি, যাহার পড়ুয়াদের অধিকাংশই দরিদ্রতম এবং পশ্চাৎপদ পরিবারের। তাহারা কর্মপত্র পাইল কি না, কয় জনের শিক্ষার অধিকার রক্ষিত হইল, সেই হিসাব শিক্ষা দফতর রাখে নাই। ভবিষ্যতে এই স্কুলছুটদের সকলেই যে স্কুলে ফিরিয়া আসিবে, এমন নহে। ইহাদের ফিরাইয়া আনিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি লইতে হইবে। সঙ্গে এই কয় মাসে যে ক্ষতি হইয়াছে, তাহা পূরণের ব্যবস্থা করিতে হইবে। অন্যথায় ইহাদের উপস্থিতি খাতায়-কলমেই থাকিয়া যাইবে, শ্রেণিকক্ষে অস্তিত্ব মিলিবে না। অতিমারির কারণে একটি শিশুও অ-শিক্ষিত থাকিয়া যাইলে, তাহা চরম দুর্ভাগ্যজনক। সেই পরিস্থিতি যাহাতে না-ঘটে, নিশ্চিত করিতে হইবে সমস্ত পক্ষকে।