rajanikanta sen

কান্তকবির গানেই আশ্রয়

বাংলা সাহিত্যের পঞ্চকবির অন্যতম দুই কবির জন্মের মাস জুলাই। তাঁরা হলেন কৃষ্ণনগরের দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রাজশাহির রজনীকান্ত সেন। প্রায় সমবয়সি দু’জনেই স্বল্পায়ু, দু’জনেই হাসির গানে, স্বদেশি গানে অবিভক্ত বাংলা মাতিয়েছেন। একদা রাজশাহিতে মিলন হয়েছিল দু’জনের। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানে অনুপ্রাণিত ছিলেন রজনীকান্ত। অনেকের কাছে তাই তিনি ছিলেন ‘রাজশাহির ডি এল রায়’। যদিও স্বভাবে বিপরীতমুখী দু’জনের প্রথম জন সাহেবি আদবকায়দায় আত্মনির্ভর, অন্য জন ঈশ্বরে সমর্পিত ‘সাধক’। মৃত্যুশোক আর বিপর্যয় ভরা রজনীকান্তের জীবন। তাঁর ভক্তিমূলক গানের জন্যই বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে কান্তকবি স্মরণীয় হয়ে আছেন। আজ রজনীকান্ত সেনের ১৫৫তম জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে লিখলেন সুব্রত পালতাঁর জীবন মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছরের। এই স্বল্পায়ু জীবন জুড়েই মৃত্যু আর বিপর্যয়ের ঘনঘটা দেখতে পাই। ছিল অটল ঈশ্বরভক্তি। কিন্তু তাঁর ঈশ্বর তাঁকে রক্ষা করেননি। আঘাতের পর আঘাত যেন তাঁর জীবনের ভবিতব্য হয়ে উঠেছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২০ ০১:৫৩
Share:

রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০)

একটা দৃশ্য কল্পনা করুন। একই ঘরে পাশাপাশি দু’টি বিছানা। দুই ভাই-বোন ম্যালেরিয়া জ্বরের ঘোরে মৃত্যুশয্যায় শায়িত। কবি রজনীকান্ত সেনের দুই ছেলে-মেয়ে। জ্ঞানেন্দ্রনাথ আর শতদলবাসিনী। দু’জনেই বেহুঁশ। সন্ধের দিকে শতদলবাসিনীর মৃত্যু হল।
রজনীকান্ত এক বন্ধুর সঙ্গে ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাইরের ঘরে। হারমোনিয়াম নিয়ে অবিরাম গেয়ে চললেন একটা গান— “তোমারি দেওয়া প্রাণে, তোমারি দেওয়া দুখ,/ তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব,/ তোমারি দু-নয়নে, তোমারি শোকবারি,/ তোমারি ব্যাকুলতা, তোমারি
হা-হা রব।...”
এই গানেরও একটা প্রেক্ষাপট আছে। এক বছর আগে তাঁর আর এক পুত্র, ভূপেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছিল। তার মৃত্যুর পরের দিন পুত্রশোক নিয়েই রজনীকান্ত এই গানটা লিখেছিলেন। কন্যা শতদলের মৃত্যুর পর তিনি এই গানটাই গেয়ে চললেন। তখনও এক ছেলে জ্ঞানেন্দ্রনাথ অজ্ঞান। মৃত্যু শিয়রে তার। কবিকে ভিতরে যাওয়ার জন্যে সকলে অনুরোধ করছেন। তিনি যাচ্ছেন না। অনেক রাতে কবি উঠে বন্ধুকে বললেন— “চলো ভিতরে গিয়ে দেখি, একটিকে ভগবান গ্রহণ করেছেন, এটিকে কী করেন দেখা যাক।”
সে বারে অবশ্য জ্ঞানেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত বেঁচে উঠেছিল।
এ কেবল রজনীকান্তের জীবনে একমাত্র ঘটনা নয়। তাঁর জীবন মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছরের। এই স্বল্পায়ু জীবন জুড়েই মৃত্যু আর বিপর্যয়ের ঘনঘটা দেখতে পাই। ছিল অটল ঈশ্বরভক্তি। কিন্তু তাঁর ঈশ্বর তাঁকে রক্ষা করেননি। আঘাতের পর আঘাত যেন তাঁর জীবনের ভবিতব্য হয়ে উঠেছিল। তাতে অবশ্য তাঁর বিশ্বাস এতটুকু টলেনি। গানে গানে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর গানের এই বাণী তো অনেকেই শুনেছেন— “(আমি) অকৃতী অধম বলেও তো, কিছু/কম করে মোরে দাওনি!/যা দিয়েছ তারি অযোগ্য ভাবিয়া,/কেড়েও তো কিছু নাওনি”।
হাসির গান, স্বদেশি গান তিনি অনেক লিখেছেন। সেগুলো জনপ্রিয়ও হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রজনীকান্ত। অনেকের কাছে তাই তিনি ছিলেন ‘রাজশাহির ডি এল রায়’। কিন্তু ভক্তিমূলক গানের জন্যই বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে কান্তকবি স্মরণীয় হয়ে আছেন। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন তাঁকে ‘দ্বিতীয় রামপ্রসাদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন ‘সাধক কবি রজনীকান্ত’।
কবি রজনীকান্ত সেনের জন্ম ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই। বর্তমান বাংলাদেশ, মানে তখনকার পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলার ভাঙাবাড়ি গ্রামে। কিন্তু তাঁর শিক্ষা, কর্ম ও সাহিত্যচর্চা সবই ছিল রাজশাহিতে। সংক্ষেপে তাঁর বংশপরিচয় হল— জ্যেঠামশাই গোবিন্দনাথ সেন রাজশাহির প্রতাপশালী উকিল। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন নিম্নদেওয়ানি আদালতের বিচারক বা মুন্সেফ। পরে সাব-জজ হয়েছিলেন। বাবা ছিলেন ধার্মিক মানুষ, তিনি ব্রজবুলি ভাষায় প্রায় সাড়ে চারশো পদ লিখেছিলেন এবং ‘পদচিন্তামণিমালা’ নামে পদাবলিগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন।
রজনীকান্তের বাবা অসুস্থ হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। জ্যেঠামশাই গোবিন্দনাথও ওকালতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তাঁদের একান্নবর্তী পরিবারের হাল ধরেছেন তখন জ্যেঠামশায়ের দুই ছেলে বরদাগোবিন্দ ও কালীকুমার। রাজশাহিতে তাঁরাও ছিলেন দুঁদে উকিল। হঠাৎ একদিনের অসুখে দুই ভাই-ই মারা গেলেন। কিছু দিনের মধ্যেই বরদাগোবিন্দের বালকপুত্র কালীপদ ও রজনীকান্তের ছোটভাই জানকীকান্তের মৃত্যু হল। এক জনের কালাজ্বরে, আর এক জনের কুকুরের কামড়ে।
এর পর একটা ঘটনা ঘটল। সেন পরিবারের বিশাল পরিমাণ অর্থ এক ‘কুঠি’তে লগ্নি করা ছিল। আচমকা কুঠি দেউলিয়া হয়ে গেল। বিশাল অর্থ হারিয়ে রজনীকান্তের পরিবার একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ল। বৃদ্ধ বয়সে সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে জ্যেঠামশাই বরদাগোবিন্দ আবার ওকালতি শুরু করলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই রজনীকান্তের বিএ পরীক্ষার আগে-পরে বাবা এবং জ্যেঠামশাইয়েরও মৃত্যু হল।
রজনীকান্ত ওকালতি ব্যবসা শুরু করেছিলেন ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। অল্পদিনেই কিছুটা পসারও তৈরি করলেন। কিন্তু এই কাজ তাঁর বিশেষ পছন্দের ছিল না। ছোটবেলা থেকেই তাঁর জীবন কেটেছিল কবিতা ও গান লিখে, গান গেয়ে, নাটক করে, স্ত্রী-শিক্ষার প্রচার করে। ওকালতি শুরু করার পরেও রাজশাহিতে বেশির ভাগ সময় কাটত গান গেয়ে আর নাটক করে। সংসার নিয়ে ভাবনা ছিল না। তাঁদের বিশাল সংসারের দায়িত্ব সামলাতেন তাঁর জ্যেঠতুতো দাদা উমাশঙ্কর সেন। এই প্রতিভাবান খুড়তুতো ভাইটিকে স্নেহবশে তিনিও সাংসারিক দায়দায়িত্বে জড়াতে চাননি। কিন্তু এই অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হল না। কয়েক বছরের মধ্যেই উমাশঙ্করের ক্যানসার হল। তাতে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেল। কিন্তু উমাশঙ্কর বাঁচলেন না। একশো বছরের বেশি আগে পাঁচ হাজার টাকার পরিমাণ অনেক। বিপুল দেনার দায়-সহ সংসারের ভার চাপল রজনীকান্তের উপরে। এই সময় তাঁর জীবনে এল সেই দুঃসময়। পর পর দু’বছরে তাঁর দুই সন্তান, ভূপেন্দ্রনাথ এবং শতদলবাসিনী মারা গেল। গানের ভিতরে আশ্রয় নিয়ে কবি শোক ভুলে থাকতে চেয়েছেন। একটানা পাঁচ-ছয় ঘণ্টা গান গেয়েও তিনি ক্লান্ত হতেন না। অতি দ্রুত গান লিখতেও পারতেন।
একটা ঘটনা লিখি। তাঁর অতি বিখ্যাত স্বদেশি সঙ্গীত— ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়/মাথায় তুলে নে রে ভাই;/দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের/তার বেশি আর সাধ্য নাই’ গানটির কথা সকলেই জানেন। এই গান রচনার বিবরণ পাওয়া যায় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের লেখায়। তখন বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের যুগ। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ। রজনীকান্ত এক দিন দুপুরে রাজশাহি থেকে কলকাতায় পৌঁছেছেন। কয়েক জন ছেলে এসে তাঁকে ধরল আন্দোলনের জন্যে একটা গান বেঁধে দিতে হবে। শুনেই লিখতে বসে গিয়েছেন কবি। খানিকটা লিখেই ছেলেদের বললেন, “চলো, জলদার প্রেসে যাই। একদিকে গান কম্পোজ হবে, অন্যদিকে গান বাঁধাও চলবে।’’
প্রেসে গিয়ে কম্পোজ করতে করতেই গান বাঁধা হয়ে গেল। সুর দেওয়াও হয়ে গেল। সন্ধের মধ্যেই সেই গান কলকাতার পথে মিছিলের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। রমেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী স্মৃতিচারণা করেছেন— “১৩১২ সালের ভাদ্র মাসে বঙ্গব্যবচ্ছেদ ঘোষণার কয়েক দিন পর কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরিয়া কতকগুলি যুবক নগ্নপদে ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গান গাহিয়া যাইতেছিল। এখনো মনে আছে, গান শুনিয়া আমার রোমাঞ্চ উপস্থিত হইয়াছিল।’’
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ৪১ বছর বয়স থেকেই রজনীকান্ত নানা রকম রোগে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন। শেষে ১৯০৯-এর কোনও এক সময়ে তাঁর গলায় ক্যানসার রোগ ধরা পড়ে। কলকাতার দেশি-বিদেশি নামী ডাক্তারদের চিকিৎসাতেও কোনও লাভ হল না। দৈব-বিশ্বাসী রজনীকান্ত দৈব-চিকিৎসার জন্যে বারাণসী গেলেন। কয়েক মাস সেখানে চিকিৎসা করে রোগ আরও বেড়ে গেল। কলকাতায় ফিরে শ্বাসকষ্ট ও যন্ত্রণা এত বৃদ্ধি পেল যে, তাঁকে তড়িঘড়ি মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গিয়ে গলায় 'ট্র্যাকিওস্টমি' অপারেশন করা হল। গলার কাছে একটা ফুটো করে বাইরে থেকে শ্বাস নেওয়ার জন্যে একটা নল লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাতে তাঁর জীবন রক্ষা পেল বটে, কিন্তু গানের কণ্ঠ চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। ১৯১০-এর ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে মেডিক্যাল কলেজের কটেজ ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়। এর পর মাস-সাতেক সেখানেই অবর্ণনীয় শারীরিক কষ্টের মধ্যে কাটিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর।
জীবনের সেই শেষ কয়েক মাস হাসপাতালের দুঃসহ দিনগুলোয় বাক্যহারা রজনীকান্ত অদম্য প্রাণশক্তিতে সাহিত্যচর্চা করে গিয়েছেন। হাসপাতালে অসুস্থ কবিকে দেখে শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছিলেন— ‘‘সেদিন আপনার রোগশয্যার পার্শ্বে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি।...শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই... কাঠ যত পুড়িতেছে, অগ্নি আরো তত বেশি করিয়াই জ্বলিতেছে।’’
এই হাসপাতাল পর্বেই তিনি ‘আনন্দময়ী’ গ্রন্থের সমস্ত গান রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া, ‘অমৃত’ নামে শিশুপাঠ্য বইটিও তাঁর হাসপাতাল জীবনের সঙ্গে ওতঃপ্রোত হয়ে আছে। ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই’ কিংবা ‘নর কহে ধূলিকণা তোর জন্ম মিছে’ ইত্যাদি আট লাইনের নীতিশিক্ষামূলক কবিতাগুলো এই বইয়েরই অন্তর্গত।
এটা সত্যি যে রজনীকান্তের মৃত্যু হয়েছে দীর্ঘ যন্ত্রণাযাপনের মধ্য দিয়ে, চিকিৎসার খরচ তো বটেই, সংসার চালানোর মতো সংস্থানও তাঁর ছিল না, কিন্তু সারা বাংলার খ্যাত-অখ্যাত অজস্র মানুষের সাহায্য-সাহচর্য তিনি অকুণ্ঠ ভাবে পেয়েছেন। খাতায় উত্তর লিখে লিখে তিনি তাঁদের সঙ্গে বার্তালাপ করতেন। এত মানুষের ভালবাসা, শুভেচ্ছা সমস্তকেই ‘সাধক কবি’ তাঁর ঈশ্বরের দান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু দুঃসহ শরীরকষ্ট আর নিঃস্ব জীবনেও যে অবিরাম সৃষ্টিস্পৃহা তাঁর ভিতরে সদাজাগ্রত ছিল, তার উৎস সম্ভবত মানুষের কর্মশীলতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ। মৃত্যুর আগেই রজনীকান্ত ছবির মানুষ হয়ে যেতে চাননি।
‘অমৃত’ বইয়ের শিশুপাঠ্য কবিতাতেও লিখেছিলেন তিনি সামর্থ্য-শক্তি থাকা সত্ত্বেও যে মানুষ কিছুই করে না— “সে নর চিত্রিত এক ছবির মতন,—/ গতি নাই, বাক্য নাই, জড়, অচেতন।’’

Advertisement

প্রাবন্ধিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন