সম্পাদকীয় ২

অভয়াঙ্ক

সমস্যাটি অবশ্য কেবল ভারতের নহে। শ্রেণিকক্ষে যে ভাবে অঙ্ক কষিবার শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহা শিশুদের স্বাভাবিক ক্ষমতাকে বিকশিত করিবার পরিবর্তে প্রতিহত করে, এমন একটি সম্ভাবনার কথা বিশেষজ্ঞরা বহু দিন বলিতেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৮ ০০:২১
Share:

সত্যজিৎ রায়ের একটি ছোট গল্পে এক স্কুলছাত্রের দৃঢ় ধারণা জন্মাইয়াছিল, তাহার অঙ্কের শিক্ষক মনুষ্যরূপী রাক্ষস। কল্পনাপ্রবণ বালকের মনে রূপকথা ও বাস্তবের রেখাটি আবছা হইতে পারে, কিন্তু অঙ্কে ভয় পায় নাই, এমন শিশু বিরল। অবশেষে শিশুদের গণিতভীতিকে কেন্দ্রীয় সরকার একটি সমস্যা বলিয়া স্বীকার করিল। প্রতিকারের পদ্ধতিটি অবশ্য পরিচিত। একটি কমিটি তৈরি করিয়া তাহার মাথায় গুজরাতের শিক্ষামন্ত্রীকে বসানো হইয়াছে। অঙ্কের পঠনপাঠনে কী কী পরিবর্তন আনিলে শিশুরা গণিতকে সাগ্রহে গ্রহণ করিতে পারে, তাহার সুপারিশ করিবে কমিটি। প্রশ্ন উঠিয়াছে, কেন শিক্ষার সংস্কারের নেতৃত্বে মন্ত্রী থাকিবেন, শিক্ষাবিদ বা শিক্ষক থাকিবেন না? সম্ভাব্য কারণ, সরকার এই রূপেই কাজ করিতে অভ্যস্ত। কমিটি বসাইলে, এবং তাহার রাশ নেতাদের হাতে রাখিলে, সব দিক বজায় থাকিবে। কিন্তু সে বিতর্ক মূল সঙ্কট হইতে যেন দৃষ্টি না ঘুরাইয়া দেয়। গণিতে দুর্বলতার অর্থ দুর্বল মানবসম্পদ। বয়স বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের গণিতভীতি কমিতেছে না, বরং বাড়িতেছে, তাহার ইঙ্গিত মিলিয়াছে এক সাম্প্রতিক সর্বভারতীয় সমীক্ষায়। গণিত পরীক্ষার ফলে প্রকাশ, উচ্চতর শ্রেণিতে উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের অঙ্কের ফলে অবনতি হইতেছে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয়, পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণির শিশুরা যথাক্রম একাত্তর, আটচল্লিশ এবং উনচল্লিশ শতাংশ প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিয়াছে।

Advertisement

সমস্যাটি অবশ্য কেবল ভারতের নহে। শ্রেণিকক্ষে যে ভাবে অঙ্ক কষিবার শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহা শিশুদের স্বাভাবিক ক্ষমতাকে বিকশিত করিবার পরিবর্তে প্রতিহত করে, এমন একটি সম্ভাবনার কথা বিশেষজ্ঞরা বহু দিন বলিতেছেন। তাঁহারা দেখাইয়াছেন, বাজারে জিনিসপত্র বিক্রয়ের কাজে বহু শিশুবিক্রেতা যথেষ্ট দক্ষ। যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ সকলই অতি সত্বর সারিয়া ফেলিতেছে। কিন্তু স্কুলের পরীক্ষায় তাহাদের ফল অতিশয় খারাপ। এমনকী প্রাপ্তবয়স্ক বিক্রেতাদের ক্ষেত্রেও এই পার্থক্য দেখা গিয়াছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই সমস্যাকে মর্যাদা দিয়াছে, এবং প্রাথমিক স্কুলের অঙ্ক পড়াইতে ক্রয়-বিক্রয় প্রভৃতি বাস্তব পরিস্থিতির অনুকরণ করিতেছে। আক্ষেপ, এমন উদ্যোগ এখনও ব্যতিক্রম। বিশেষত ভারতে। এই দেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণে পাঠদানের নূতন নানা পদ্ধতি শিখাইলেও, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা তাহা অনুসরণ করেন না। নিজেরা শৈশবে যে পদ্ধতি শিখিয়াছেন, তাহাই প্রয়োগ করেন। তাহাতে যে অধিকাংশ শিশুর উন্নতি হয় নাই, তাহা বুঝিয়াও তাঁহারা নির্বিকার।

শিক্ষার সংস্কারে কমিটি গঠন করিবার সমস্যা এইখানে। শীর্ষে যিনিই থাকুন, তাঁহার সুপারিশ কাগজ-কলমে থাকিয়া যাইবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। নূতন পাঠ্যক্রম, পাঠদানের নূতন পদ্ধতি, মূল্যায়নে পরিবর্তন পূর্বেও প্রস্তাবিত হইয়াছে। সেই সকল গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর সংস্কার শ্রেণিকক্ষে কতটা প্রয়োগ করা হইতেছে, দেখিবে কে? এমনকী শিক্ষা-সহায়ক খেলনাগুলিও বাক্সবন্দি পড়িয়া থাকে স্কুলগুলিতে। নিরানন্দ নামতা মুখস্থ করিয়া, দুর্বোধ্য পাঠ বুঝিবার চেষ্টা করিয়া শিশুরা অকারণ কালক্ষেপ করিতেছে। পাঠ্যক্রম, পাঠদানে পরিবর্তন চাই, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকের সম্পর্কেও সংস্কার আনিতে হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন