পশ্চিমবঙ্গের পুরভোট অভিজ্ঞতা বলিয়া দিল, রাজ্যে যে বস্তুটি আজও প্রতিষ্ঠিত হইল না, তাহার নাম রাজধর্ম। এবং সেই ধর্মচ্যুতির শিকার গণতন্ত্র, নির্বাচন যাহার একটি মৌলিক প্রক্রিয়া। পুরসভার ভোটপর্বে বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ মাৎস্যন্যায়ের প্রদর্শনী হইল। দর্শকদের দুইটি ভাগ। এক দিকে অসহায় দর্শক, সাধারণ মানুষ যাঁহারা ভোট দিবার চেষ্টা করিয়াছেন, আশা করিয়াছেন যে ভোটের নামে তাণ্ডব কেহ বা কাহারা আসিয়া থামাইবে। আর অন্য ভাগটি সহায়ক দর্শক, যাঁহারা নীরব নিষ্ক্রিয়তা দিয়া পরিস্থিতিকে সমর্থন করিয়াছেন, রাজ্যের কলঙ্ক বাড়াইয়াছেন। অতীব দুর্ভাগ্যজনক, রাজ্যের প্রশাসন এই দ্বিতীয় ভাগ বা সহায়ক দর্শকের অন্তর্ভুক্ত। যাঁহাদের কাজ ভোটের নামে ভাঙচুর বন্ধ করা, অপরাধীদের শায়েস্তা করা, তাঁহারা নির্লজ্জ ভাবে হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিয়াছেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসের তুলনাতেও এই নিষ্ক্রিয়তা উল্লেখযোগ্য। বাইকবাহিনী, বোমাবাজি, বন্দুক-ত্রাস, সমস্ত কিছুর মাত্রাছাড়া আস্ফালনের সামনে পুলিশ-প্রশাসনের এই সম্মেলক নিষ্ক্রিয়তার দুইটি সম্ভাব্য কারণ। এক, তাঁহাদের একাংশ এই গোলযোগের প্রত্যক্ষ অংশীদার। দুই, বাকি অংশের উপর গোলযোগ থামাইবার বদলে হয়তো গোলযোগ বাড়াইবার নির্দেশই ছিল। বামফ্রন্ট জমানায় রাজধর্ম হইতে এই বিচ্যুতি দেখা গিয়াছে, তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনেও সেই ট্র্যাডিশন চলিতেছে। কখনও কখনও তাহার চেহারা আরও উৎকট, যেমন রবিবারের ভোটপর্বে কয়েকটি স্থানে। এই অ-শাসনের দায়িত্ব রাজ্য প্রশাসনের কর্ণধাররা অস্বীকার করিতে পারেন না। শুধু নৈতিক দায়িত্ব নহে, ব্যবহারিক দায়িত্বও।
উত্তরের দায় আরও এক পক্ষকে লইতে হইবে। তাহা নির্বাচন কমিশন। পুরভোটের দিন নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্ব পুরাপুরি উবিয়া গেল, যদিও কয়েক দিন আগেই কমিশনের পক্ষ হইতে একাধিক আশঙ্কা প্রকাশ করিতে দেখা গিয়াছিল। প্রশাসনের কাছে গিয়া স্বয়ং নির্বাচন কমিশনার গুন্ডাদমনের সহায়তা চাহিয়াছিলেন। আশঙ্কা, রাজ্য প্রশাসন রাজধর্মের বদলে দলধর্ম পালনে প্রতিশ্রুত, ফলে কমিশনার তাঁহার প্রার্থিত এবং প্রাপ্য সহায়তা পান নাই। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো রাজ্য সরকারের তাঁবে নহে, তাহা একটি স্বতন্ত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। রাজ্য সরকারের সহায়তা ছাড়াও তাহার নিজস্ব করণীয়, নিজস্ব ভূমিকা থাকিয়া যায়। বাস্তবিক, যে রাজ্যে সরকার ‘সহায়তা’ করিবার পরিস্থিতিতে নাই, সেখানেই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব আরও গুরুতর। নিরপেক্ষতার পরিবেশ না থাকিলেই কমিশনের আরও সক্রিয় ও সতেজ ভাবে দায়িত্ব পালন করা উচিত। তাহা ঘটিল না। এমনকী পুরভোটের দিন কমিশনারের কাছে নাগরিকরা তাণ্ডবের প্রতিবাদ করিতে গিয়া তাঁহাকে খুঁজিয়াই পাইলেন না! মীরা পান্ডে ইতিহাস হইয়াছেন, ইতিহাসই থাকিলেন।
এই সার্বিক ধ্বস্ত প্রশাসনের মধ্যে সরকারি দল বিরোধী দল একে অপরের প্রতি অভিযোগবর্ষণে ব্যস্ত। অথচ অভিযোগ-প্রত্যভিযোগের বিচার সম্পূর্ণ গৌণ, হয়তো বা অর্থহীন। নির্বাচনের দিন মানুষ আসিয়া ভোট দিবেন, তাহাতে যে বা যাহারা বাধা দিবে, তাহাদের ব্যবস্থা প্রশাসন করিবে, ইহাই সভ্য গণতন্ত্রের দস্তুর। সুতরাং গুন্ডারা তৃণমূলের না বিজেপির, নাকি বিজেপির ছদ্মবেশে তৃণমূল, এইগুলি কোনও বিচার্য বিষয় নয়। রাজ্য প্রশাসন গুন্ডাদের মোকাবিলা করিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ, ইহাই শেষ কথা। অথচ রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীরা অবলীলায় সরকারি দায়িত্বের গোড়ার কথাটি ভুলিয়া গিয়া অন্য দলের দিকে আঙুল তুলিতেছেন। আত্মবিস্মৃতির ইহাই শেষ দশা! উহাদের গুন্ডা বলিলেই যেন নিজ দায়িত্ব চুকাইয়া দেওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গ এখন দায়িত্বজ্ঞানরহিত আত্মবিস্মৃতির মুখাপেক্ষী হইয়া বাঁচিতেছে।