Rajshekhar Basu

Byomkesh Bakshi: ভাগ্যিস রাখাল মুস্তৌফী গোয়েন্দা হয়নি, ব্যোমকেশ ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেল

রাখালের জীবনের আর একটা কথা না বললে নয়। সেটা তার প্রেম। বছর তেত্রিশের রাখাল ব্যাচেলর।

Advertisement

মুকুল দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৪:২৩
Share:

শারলক হোম্‌সেরও ভুরু কুঁচকে দিয়েছিলেন রাখাল মুস্তৌফী গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

(১)

Advertisement

‘কাল রাত্রে আমাদের ভাল ঘুম হয় নি তা বুঝলেন কি করে?

শারলক হোম্‌স বললেন, এলিমেন্টারি ওঅটসন, অতি সহজ। আমাদের মুখে মশার কামড়ের দাগ রয়েছে। আমরা মশারির মধ্যে শুই নি, পাংখাপুলারও মাঝরাত্রে পালিয়েছিল। কিন্তু আর দুটো বিষয় টের পেলেন কি করে?’


ওয়াটসনকে ‘অতি সহজ’ বিষয়টা বুঝিয়ে বললেও, তিনটে বিষয়ের বাকি দুটোর ভাঁজ খুলতে পারেনি হোমস। তাই ওয়াটসনের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে (ধরেই নেওয়া যায় বিস্ময়ের ভ্রূকুঞ্চন-সহ) অন্য জনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল— ‘কিন্তু আর দুটো বিষয় টের পেলেন কি করে?’

এই কথোপকথন চলছে বেহালার বাড়িতে। শার্লক হোমসকে যে, তদন্তের কাজে উনবিংশ শতাব্দীর এঁদো বেহালায় আসতে হয়েছিল তা হয়তো হোমস-প্রেমীদেরও অনেকের জানা নেই। স্যর কোনান ডয়েল সেটা জানিয়েও যাননি। জানিয়েছেন পরশুরাম ওরফে রাজশেখর বসু মহাশয়। তবে হোমস-ওয়াটসন জুটি যে সময় বেহালায় রাখাল মুস্তৌফীর বাড়িতে, তখনও ডয়েল ‘নাইট’ পাননি। অর্থাৎ ‘স্যর’ হননি। রাজশেখরের বর্ণনায়, সেটা ‘কুইন ভিক্টোরিয়ার আমল। তখন কলকাতায় বিজলী বাতি, মোটর গাড়ি, রেডিও, লাউড স্পীকার ছিল না, আকাশে এয়ারোপ্লেন উড়ত না, রবীন্দ্রনাথ প্রখ্যাত হন নি, লোকে হেমচন্দ্রকে শ্রেষ্ঠ কবি বলত।’

Advertisement

রাখাল তা এক্কেবারেই মানত না। সে নিজেকে অনেক বড় কবি বলে মনে করত। এ হেন রাখালের বাড়িতে এক রবিবারের সকালে হাজির তিন অচেনা আগন্তুক। রাখাল তখন বারান্দার তক্তপোশে বসে হুঁকো টানছে আর কবিতা লিখছে। রাখালের কবিতা যেমন কোনও কালে কোথাও ছাপা হয়নি, তেমনই রাখাল কখনও অপরাধী ধরতে গোয়েন্দা হয়েছে এমনও কেউ শোনেনি। কিন্তু বাড়ি থেকে একশো গজ দূরের রাস্তায় ফিটন গাড়ি থেকে নেমে ওরা যখন রাখালের দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে, তার চোখ তখন পাকা গোয়েন্দার পর্যবেক্ষণশক্তিতেই নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে। রাখাল দেখল দু’জন সাহেব আর একজন বাঙালি। ‘সাহেবদের একজন লম্বা রোগা, গোঁফদাড়ি নেই, গাল একটু তোবড়া...।’ তিনজনকেই এ ভাবে ‘মেপে’ নিচ্ছিল রাখালের চোখ। সে দেখার নমুনা একটু পরেই পাবে শার্লক হোমস স্বয়ং।

হোমস-ওয়াটসন জুটি যে সময় বেহালায় রাখাল মুস্তৌফীর বাড়িতে, তখনও ডয়েল ‘নাইট’ পাননি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আর পাঁচজনের থেকে গোয়েন্দাদের আলাদা করে তাদের ধূর্ত ইন্দ্রিয় আর মগজ। কেউ কেউ এর সঙ্গে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের কথাও বলেন। রাজশেখর তার রাখাল মুস্তৌফীকে এই সবকটি অস্ত্র দিয়েও গোয়েন্দাগিরির দিকে ঠেলেননি। এন্ট্রান্স পাশ, বিস্তর বাংলা ইংরেজি বই পড়া, কবি হিসেবে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা এক গরিব স্কুলমাস্টার (‘পাড়ার লোকে বলে পাগলা মাস্টার’) করেই রেখে দিয়েছেন।

স্কট, ডিকেন্স, লিটন, ইলিয়ট থেকে শুরু করে রেনল্ডসের ক্রাইম স্টোরি পড়া রাখাল, শার্লক হোমসের নামটাও জানে না শুনে বেশ বিব্রতই হয়ে পড়ে ওয়াটসন। ফস্ করে বলেই ফেলল, ‘তা হলে আমার এই বিখ্যাত বন্ধু সম্বন্ধে আপনি কিছুই জানেন না’! রাখাল ওয়াটসনের ভাব দেখে কুণ্ঠিত হয়ে পড়ে। সলজ্জেই নিবেদন করে—
‘শুধু এইটুকু জানি, ইনি এই দেশে প্রথম এসেছেন, কিন্তু আপনি নতুন আসেন নি।
‘লম্বা সাহেব (হোমস) আশ্চর্য হয়ে বললেন, দ্যাট্‌স ফাইন! আর কি জানেন মিস্টার মুস্তৌফী?
‘— কাল রাত্রে আপনাদের ভাল ঘুম হয়নি।
‘— ভেরি ভেরি গুড! আর কি জানেন?
‘— আপনারা কাল লংকা খেয়েছিলেন।’

উচ্ছ্বসিত হোমস ওয়াটসনকে বলে ওঠে, এটাই হল ‘সায়েন্স অভ ডিডকশন’! হোমস নিজেও এই তিনটে ‘ডিডকশন’-এর দুটো ধরতে পারেনি। রাখালের কাছেই পরে শুধিয়ে নিতে হয়।

রাজশেখর তার রাখাল মুস্তৌফীকে এই সবকটি অস্ত্র দিয়েও গোয়েন্দাগিরির দিকে ঠেলেননি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

(২)

বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দাদের মধ্যে বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ব্যোমকেশ। কোনও এক সময় স্বপনকুমারের ‘দীপক চ্যাটার্জী’ ফুটপাথে ফুটপাথে কত বিক্রি হয়েছিল, বা ফেলু মিত্তির অমুক বয়সের পাঠকের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, এ সব যুক্তিতে ব্যোমকেশের কিচ্ছুটি এসে যায়নি। ব্যোমকেশ এখনও তার অনাগত প্রতিদ্বন্দ্বীর অপেক্ষায়। কত কাল থাকতে হবে কেউ জানে না। ব্যোমকেশ সমগ্র, রবীন্দ্র রচনাবলির মতো অতটা না হলেও, অনেক বাড়ির বুক শেলফে না-পড়া হয়ে শুধু শো-পিস হয়ে থাকে। এটা ক্লাসিকের অন্যতম লক্ষণ। এই প্রদর্শন অ-পাঠকের পাঠগরিমা প্রকাশ করে। কেন ব্যোমকেশের এই সাফল্য? শরদিন্দু তাঁর সত্যান্বেষীকে শুধু অপরাধীদের পিছনে ধাওয়া করাননি। তার সমাজবোধ, কৌতুকবোধ, সাহিত্যবোধ, ন্যায়-অন্যায়বোধ, জীবনবোধকেও অসাধারণ কৌশলে মিশিয়েছিলেন এই চরিত্রের সঙ্গে। এই দক্ষতা ছিল রাজশেখর বসুরও। তাঁর অতি গাম্ভীর্যের আড়ালে থাকা কৌতুকি মনটাকে দেখতে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। ‘ভুশণ্ডীর মাঠ’ শুধু মজার ভূতের গল্প নয়। এখানে পরিবার আছে। আঞ্চলিক সংস্কৃতির বিভেদ আছে। বহুগামিতা আছে। মোট কথা সমাজ-সংসার-দেশ আছে ভীষণ ভাবে। যে সামাজিক-রাজনৈতিক বোধ রাজশেখরের লেখার শিরায়-ধমনীতে বয়ে চলে বাইরের মূল অবয়বকে পুষ্ট করে, সেটা তো শরদিন্দুরও ধারা। পরশুরাম তাঁর ‘কুঠার’ নিয়ে গোয়েন্দা-মহলে নামলে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ-মহাবৃক্ষকে টলাতে পারতেন কি না সে কথা অবান্তর, কথা হল ‘নীল তারা’ গল্পের রাখাল মুস্তৌফীর মধ্যেকার সুপ্ত গোয়েন্দা প্রতিভা বাঙালি পাঠকের সামনে ডালপালা মেলতে পারল না। পরশুরামের ‘সরলাক্ষ হোম’ গল্পেও গোয়েন্দাগিরি আছে। তবে সেটাও মূল কাহিনির জন্য নির্মিত একটা পার্শ্ব‘চরিত্র’ মাত্র।

রাখালের জীবনের আর একটা কথা না বললে নয়। সেটা তার প্রেম। বছর তেত্রিশের রাখাল ব্যাচেলর। তাকে এক দিন বিয়ের পিঁড়ি থেকে উৎখাত হতে হয়েছিল। সেই নিরপরাধ ষোড়শীকে সে ভুলে যায়নি। হয়তো সে জন্যই বিয়ে করেনি আর। গল্পের শেষে হোমসের প্রীতিময় সহযোগিতায় সেই মেয়েকেই বিধবা অবস্থায় নতুন করে গ্রহণ করতে চলেছে রাখাল। রাখালকে গোয়েন্দা বানালে এখানেও এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের জন্ম দিতে পারতেন রাজশেখর। কেন দেননি, তিনিই জানতেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন