CryptoCurrency

ডিজিটাল মুদ্রা: প্রশ্ন অনেক

কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতিতে যখন ভারত আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, তখন হঠাৎ কেন এত তড়িঘড়ি এই মুদ্রার প্রচলন করার কথা ভাবা হল?

Advertisement

অনির্বাণ দত্ত

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২২ ০৬:৩৯
Share:

রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ডিজিটাল মুদ্রা আনবে, বাজেট বক্তৃতায় এই কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। সেটা কি ক্রিপ্টোকারেন্সি? একদমই নয়। সরকারের ঘোষিত ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলিত নাম হতে চলেছে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি বা সিবিডিসি। আমরা এখন যে টাকাপয়সা ব্যবহার করি নোট বা কয়েনের মাধ্যমে, তাতে যেমন সরকারের সভরেন গ্যারান্টি থাকে, সিবিডিসি-তেও তা থাকবে। তাই সিবিডিসি আইনি মুদ্রা হিসেবে কাজ করবে। এটির মূল্য টাকার সমান হবে।

Advertisement

২০১৬ সালে ডিমনিটাইজ়েশনের পর থেকেই দেশে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। তা হলে, নতুন করে ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন কেন? এই ডিজিটাল মুদ্রা কোনও অতিরিক্ত সুবিধা দেবে কি? অদূর ভবিষ্যতে এই মুদ্রার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেন করা সম্ভব হবে কি না, তারও এখনও কোনও নিশ্চয়তা নেই। তা হলে কি শুধুমাত্র মানুষের উপর নজরদারি বাড়ানোর জন্যই এই নতুন কৌশল?

ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে যে সব প্রশ্নের এখনও স্পষ্ট উত্তর নেই, সেগুলো এই রকম: এই মুদ্রা কি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সরাসরি বাজারে ছাড়বে, না কি তার অধীনস্থ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে তা করা হবে? সাধারণ গ্রাহক তাঁর আমানতের টাকা যদি ডিজিটাল মুদ্রাতে পরিবর্তন করেন, তবে তিনি কি তার থেকে সুদ পাবেন? টাকার অঙ্কে গচ্ছিত আমানতের থেকে তিনি ব্যাঙ্কে সুদ পান। যদি ডিজিটাল মুদ্রা থেকে সুদ না পান তবে কেন তিনি তা নিতে যাবেন? যদি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সরাসরি গ্রাহকদের সিবিডিসি দেয়, তা হলে আমানতকারী তাঁর ব্যাঙ্কের সঞ্চিত টাকা তুলে নিয়ে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে সিবিডিসি নিতে যাবেন। সে ক্ষেত্রে কি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সরাসরি সুদ দেবে ডিজিটাল মুদ্রার গ্রাহককে?

Advertisement

যদি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সুদের হার সাধারণ ব্যাঙ্কের সুদের হারের চেয়ে বেশি হয়, তা হলে আমানতকারীরা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক থেকে তাঁদের সঞ্চয় তুলে নেবেন, এবং এর ফলে ব্যাঙ্কগুলির ভাঁড়ারে টান পড়বে। তা ছাড়াও, যে কোনও সরকারি বা বেসরকারি ব্যাঙ্কের তুলনায় মানুষ সম্ভবত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে বেশি ভরসা করবে। কারণ, বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ব্যাঙ্ক দেউলিয়া ঘোষণা হয়ে গেলে শুধুমাত্র পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতেই দায়বদ্ধ। তাই গ্রাহক তাঁর সুরক্ষার জন্য বাঙ্কে গচ্ছিত টাকার মোটা অংশ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে সিবিডিসিতে রাখতে উৎসাহিত হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আমানতের অভাবে ভারতের ব্যাঙ্কিং শিল্প এক নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। ঋণের পরিমাণ কমে যাবে এবং ব্যবসায়ীরা ঋণের অভাবে ব্যবসা করতে উৎসাহিত হবেন না এবং অর্থনীতিতে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে বাধ্য।

প্রশ্ন আরও আছে। এক বার সাধারণ টাকা ডিজিটাল মুদ্রাতে পরিবর্তিত হয়ে গেলে তা কি কোনও শর্ত ছাড়াই ফের সাধারণ টাকায় পরিবর্তন করা যাবে, বা তার জন্য কি কোনও টাকা কাটা যাবে? আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের সাপেক্ষে টাকার মূল্য ওঠানামার সঙ্গে কি সিবিডিসি-র মূল্যও ওঠানামা করবে? ডিজিটাল মুদ্রা কি যে কোনও সময় এটিএম থেকে সাধারণ টাকাতে পরিবর্তন করা যাবে?

সিবিডিসি-র মাধ্যমে লেনদেন করলে সমস্ত তথ্য সরকারের কাছে চলে যাবে এবং এই তথ্য তৃতীয় কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে পৌঁছবে না, তার নিশ্চয়তাই বা কোথায়? যে ভাবে বর্তমানে গ্রাহকদের কেওয়াইসি আপডেট করার নামে ওটিপি সংগ্রহ করে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে, তাতে ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা কোথায়?

এই মুদ্রা চালু হলে কি সাধারণ ইউপিআই লেনদেন কমে যাবে? তা হলে ইউপিআই মধ্যস্থতাকারী সংস্থাগুলি রুগ্ণ হয়ে যাবে না তো? উদ্দেশ্য মহৎ হলেও নোট বাতিল বা জিএসটির তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল, যা পরবর্তী পর্যায়ে কোভিডের ধাক্কায় আরও ভয়াবহ হয়েছে। তাই ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে অতি সাবধান পদক্ষেপই কাম্য।

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ভারতের আর্থিক বৈষম্যের এক ভয়াবহ ছবি প্রকট হয়েছে— যেখানে দেখা যাচ্ছে যে, বৃহৎ অংশের মানুষের আয় কোভিডের ধাক্কায় কমে গেছে। তাঁদের কল্যাণের ব্যবস্থা না করে তড়িঘড়ি এই ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন শুধুমাত্র জনগণের আর্থিক লেনদেনের উপর নজরদারি বাড়াবে তা-ই নয়, অদূর ভবিষ্যতে ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকেও নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে, যা কোভিডোত্তর আর্থিক উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতিতে যখন ভারত আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, তখন হঠাৎ কেন এত তড়িঘড়ি এই মুদ্রার প্রচলন করার কথা ভাবা হল? নজরদারির তাগিদ, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর মরিয়া চেষ্টা, না কি বাজেটে কোনও চমক না থাকাতে এটিকেই চমক হিসেবে তুলে ধরা হল?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন