Literature

সাহিত্য ও জীবন যখন অঙ্গাঙ্গি

আসলে তাঁর সমস্ত রচনা, সব সাহিত্যকর্ম তাঁর জীবনযাপনের অঙ্গ। তাঁকে উৎকণ্ঠিত করে তুলত ব্যক্তির বিপন্নতা।

Advertisement

নবকুমার বসু

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২২ ০৭:১৬
Share:

বা‌ংলা সাহিত্যে প্রয়াণের চৌত্রিশ বছর পরেও তাঁকে নিয়ে নিবন্ধ রচনা করা যায়, কেননা তাঁর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সমরেশ বসু প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ, শনিবার, মাত্র চৌষট্টি বছর বয়সে (জন্ম ১৯২৪, ১১ ডিসেম্বর)। ভাবনায়, ভাষায়, অনুভবের গভীরতায়, প্রকাশভঙ্গি ও বিষয়বৈচিত্রে চল্লিশের দশকের এই লেখকের বিষয়ে ভাবতে বসলে মনে হয়, কেবল তাঁর সাহিত্যসম্ভার বা সৃষ্টিধারা নয়, তাঁর যাপিত জীবন, জীবনবোধ, অভিজ্ঞতা, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বোধ-বিশ্বাস, বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও আমাদের অনুসন্ধান এখনও শেষ হয়নি। বাংলা সাহিত্যে এবং বাঙালি সাহিত্যিক হিসাবে ‘ব্যতিক্রমী’ শব্দটা তাঁর ক্ষেত্রে কতখানি প্রযোজ্য ও সুদূরপ্রসারী, যে কোনও মনোযোগী পাঠক তা জানেন। এও ভাবতে হবে যে, তাঁর আত্মপ্রকাশের সময়টিতে বাংলা সাহিত্যের নেহাত বন্ধ্যা যুগ ছিল না। তারাশঙ্কর, মানিক রয়েছেন, খ্যাতির শিখরে রয়েছেন বিভূতিভূষণ। আবার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র ছাড়াও সাহিত্য পাঠকদের তালিকায় অন্য প্রিয় লেখক-লেখিকা ছিলেন। কিন্তু সমরেশ বসু প্রথম থেকেই এমন একটি জায়গায় দাঁড়াবার উদ্যোগ করেছিলেন, যেখানে ‘উত্তরসূরি’ শব্দটির ছাপ কোনও ভাবেই তাঁর গায়ে না লাগে।

Advertisement

তাঁর বাইশ বছর বয়সের রচনা ‘আদাব’ থেকে বিয়াল্লিশ বছর পরের শেষ তথা অশেষ, অসমাপ্ত উপন্যাস দেখি নাই ফিরে— এই দীর্ঘ সম্ভার মোটামুটি উল্টে দেখলেই একটা কথা পরিষ্কার বোঝা যায়; পাঠকদের তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আমার কিছু বলার আছে। নেহাত গল্প-উপন্যাস পাঠের আনন্দ দিতে, তিনি কলম হাতে তুলে নেননি। আর সেই কর্ম করতে গিয়েই, ঝুঁকি নিয়েছেন, বিতর্কিত হয়েছেন, সমালোচনার মুখেও পড়েছেন।

আটপৌরে, মধ্যবিত্ত, মিষ্টি ভাবনায় তিনি সত্যোচ্চারণকে আড়াল করে রাখেননি, যে কারণে ক্রমশ বোঝা গিয়েছিল, সমরেশ বসু শুধু কল্পনাবিলাস আর খালি হাতে সাহিত্যচর্চা করতে আসেননি। জীবনে ও যাপনে তাঁর সাহস তো ছিলই, তার সঙ্গেই ছিল প্রবল কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য এবং বহন করার ক্ষমতা। লেখক হওয়ার জন্য আর যা কিছু বোধ, উপলব্ধির সঙ্গেই উল্লিখিত গুণ, তাঁকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছিল প্রথম থেকে। অনেক রচনাকারের ক্ষেত্রেই তাঁদের মফস্সলি অথবা শহুরে অভিজ্ঞতা ও জীবনযাপনের সুখী কিংবা ম্লান পৌনঃপুনিকতায় যে একঘেয়েমির সুর ধ্বনিত হয় লেখায়, সমরেশ বসু সেখানে মূর্তিমান ব্যতিক্রম হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিলেন, এবং তার জন্য শুধু নিন্দা বা প্রশংসা নয়, লেখকজীবনে খেসারতও কম দিতে হয়নি তাঁকে। স্রোতের বিপরীতে যাওয়া, ভাঙা এবং ভাঙতে ভাঙতেই তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির কারিগর হয়ে উঠে আসা।

Advertisement

চার দশকের সামান্য বেশি নিরবচ্ছিন্ন রচনা প্রবাহের দিকে তাকালে বোঝা যায়, বিশেষত উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রায় দশকে-দশকে তিনি দিক বদল করেছেন। আবার নিজস্ব সৃষ্টির শ্রোতধারার মধ্যেই অন্য আবর্ত সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু একই জায়গায় থেমে থাকেননি। তাঁর প্রথম জীবনের কয়েকটি রচনাতেই গঙ্গার উভয় পারের মানুষের কূল ভাঙার ইতিহাস আর মাটির মানুষের কলের মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার ইতিবৃত্ত বর্ণিত হয়েছিল। একই সঙ্গে শ্রমজীবী ও নিম্নশ্রেণির মানুষদের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে উঠেই বাংলা সাহিত্যের আসরে আসন পেতে দিয়েছিলেন।

অথচ খুব দ্রুতই বোঝা গিয়েছিল লেখার আখর বদলানোর উদ্যোগ করেছেন সমরেশ। কুম্ভমেলায় যাওয়ার সুযোগে যেন আপনসত্তারই আর এক নতুন দিগন্তের সন্ধান পেলেন। কালকূট-এর জন্ম হলেও, অমৃতকুম্ভের সন্ধানে-তেই পায়ের নীচে মাটি পেলেন। কিন্তু না, সেই সাফল্যের মাটি আঁকড়ে না থেকেই রচনার বিষয় আর ক্ষেত্র আবার বদলে ফেললেন। গঙ্গায় মাছমারাদের বিচিত্র জীবন, অনিশ্চয়তা, জল আর তার গভীরে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে উঠে আসে যে রুপালি ফসল... সেই দিবারাত্রের বারোমাস্যা সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে উঠে এল সমরেশ বসুর কলমে। অথচ পদ্মানদী, তিতাস, ইছামতী থেকে তাঁর ‘গঙ্গা’-র বিস্তার বয়ে গেল
অন্য (সমুদ্রের) টানে। তার মধ্যেই কখন রচিত হয়েছে বাঘিনী, ত্রিধারা। আর মগ্নচৈতন্যে তখনই যেন লেখক সাহিত্যজীবনে আবার বড় বাঁক নেওয়ার জন্য দম নিচ্ছিলেন। স্বীকারোক্তি-বিষয়-প্রজাপতি-পাতক, নতুন রীতি এক-একটি অঙ্কে আবারও দুর্বার, দুঃসাহসী, অপ্রিয় সত্যভাষী সমরেশ বসু। বোধ হয় অনিবার্য ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে নিজেকেই নতুন করে আবিষ্কার করে চলেছিলেন এক লেখক, যিনি সাহিত্যকে জীবন থেকে আলাদা করেননি।

আসলে তাঁর সমস্ত রচনা, সব সাহিত্যকর্ম তাঁর জীবনযাপনের অঙ্গ। তাঁকে উৎকণ্ঠিত করে তুলত ব্যক্তির বিপন্নতা। নিজের জীবনের সঙ্কটের মধ্যে দিয়েই উপলব্ধি করতেন সেই বিপন্নতা, আর পর্বে-পর্বে তাই প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর রচনায়। তৃতীয় পর্বে টানাপড়েন, খণ্ডিতা, শিকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে কিংবা মহাকালের রথের ঘোড়া আপাতদৃষ্টিতে নতুন পর্বের রচনা মনে হলেও, মগ্ন পাঠক অবশ্যই আবিষ্কার করেন জীবন ও সাহিত্যের বন্ধন সেখানেও শিথিল হয়নি।

তাঁর প্রয়াণের চৌত্রিশ বছর পরে এবং জন্মশতবর্ষের মাত্র দু’বছর আগেও তাঁর সেই ফেলে-যাওয়া স্থান পূর্ণ হল কি না, এই কথাটিই হয়তো ভাবার। সৃষ্টিকর্মের আবহে-আবেগে-বিতর্কে প্রাণবন্ত করে রাখা বাংলা সাহিত্যের জগতে কম কথা নয়। খুব কৃতী লেখক হলেই তা হয় না, তার জন্য গভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হয়। এমন এক জন লেখক হতে হয় যিনি নেজের লেখা দিয়েই পাঠকের প্রত্যাশা সমানে নতুন ভাবে তৈরি করে নিতে পারেন।

একমাত্র তা হলেই তিনি পারেন এত দিন ধরে প্রাসঙ্গিক থাকতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন