Tired

ক্লান্ত হওয়ার অধিকার?

দেশে দেশে এলিট কর্মীরা ডিজিটাল যুগের ‘অলওয়েজ় অন’ কর্মসংস্কৃতির বিরোধিতা করছেন। নানা দেশে আইন হচ্ছে, কাজের সময় পেরিয়ে গেলে আর ফোন, মেসেজ, ইমেলে উৎপাত নয়।

শরণ্য সেন

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৫৯
Share:

সম্প্রতি দেশের আকাশ জুড়ে দেখা গেল দুর্যোগের ঘনঘটা। প্রায় একচেটিয়া বিমান সংস্থার সারি দিয়ে বিমান বাতিলের জেরে এয়ারপোর্ট গঙ্গাসাগরের বাবুঘাট, কাউন্টারে বাগ্‌বিতণ্ডা, সরকার-বিরোধী তীব্র বয়ানবাজির ধূমকুণ্ডলী এতটাই ঘন যে তলার আঁচটা আলোচনার বাইরেই যেন থেকে গেল। অসামরিক বিমান মন্ত্রকের নির্দেশিকায় বিমানচালকদের বাধ্যতামূলক বিশ্রামের সময় বেড়ে গিয়েছে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টা। তাঁদের রাত্রিকালীন অবতরণের সংখ্যা ছয় থেকে নেমে এসেছে দুইয়ে। আর এতেই বিমান সংস্থায় ত্রাহি মাম্ রব। অভিযোগ, দীর্ঘ সময় পাওয়ার পরেও তারা বেশি সংখ্যক বিমানচালক নিয়োগের কোনও উদ্যোগই করেনি।

এক কথায়, কর্মীর ক্লান্তির অধিকারকে সরাসরি অস্বীকার করেছে। শেষ পর্যন্ত যে রফাসূত্র মিলেছে এই সঙ্কটের, তা মূলত ‘পুনর্মূষিকো ভব’। নতুন নির্দেশিকা আপাতত মুলতুবি থাকছে। অর্থাৎ, ক্লান্তি ও তজ্জনিত বিশ্রামের অধিকারকে হিমঘরে পাঠানো হল আপাতত।

যদিও ক্লান্তির ও তার থেকে চাঙ্গা হওয়ার জন্য বিশ্রামের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি রয়েছে ভীষণ ভাবেই। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সনদের ২৪ নম্বর ধারা শুধুমাত্র বিশ্রাম নয়, অবসরকালীন চিত্তবিনোদনের অধিকারকেও মান্যতা দেয়। গুরুত্বের দিক থেকে তা এতটাই ওজনদার যে তাকে সম্মানজনক জীবনধারণের উপযোগী কাজের অধিকারের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হিসাবেই দেখা হয়। অথচ চার পাশে পেশাজনিত ক্লান্তিকে অদেখা করার, এমনকি হেয় করার প্রবৃত্তি যেন কাঠামোগত রূপ নিয়ে চলেছে নিয়ত। ফলে যাত্রীর অস্বাচ্ছন্দ্য সঙ্গত ভাবে আলোচনায় এলেও, বিমানচালকের ক্লান্তি নিয়ে কথা প্রায় নেই।

সাম্প্রতিক কালে বিএলও-দের পেশাগত ক্লান্তি নিয়ে সমাজমাধ্যমে ট্রোলের বন্যা বয়ে চলেছে। রেল-দুর্ঘটনায় যতটা কথা হয় সিগন্যালিং-এর সমস্যা, কবচ-সুরক্ষার অত্যল্পতা নিয়ে, রেলকর্মী, বিশেষত চালকদের ক্লান্তি নিয়ে তার ভগ্নাংশও হয় না। ভারতের ট্রাকচালকদের ক্লান্তি ও নিদ্রাল্পতা নিয়ে রীতিমতো ভয় ধরানো তথ্য উঠে আসে নানা গবেষণায়। দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়লেও রাজপথ সম্প্রসারণের গ্ল্যামারে তাঁদের ক্লান্তি ঢাকা পড়ে যায়।

তার সঙ্গে ভারতীয় সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিও ক্লান্তিকে অস্বীকার করতে এক রকম যেন বদ্ধপরিকর। ওয়টস্যাপ ইউনিভার্সিটি জানিয়ে যায় নেতা দিনে কুড়ি ঘণ্টা কাজ করছেন; তাবড় কর্পোরেট কর্তা নিদান দেন নব্বই ঘণ্টার কর্মসপ্তাহের। স্কুলের ছেলেমেয়েদের ছোট ক্লাসের ছুটিতে নানা ক্যাম্প, বড় ক্লাসে নির্বাচনী পরীক্ষার কোচিং-এর ঠেলায় ছুটি অস্তিত্বহীন আর ক্লান্তি অপরাধ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সিমেস্টারে ঠেসে ঢুকিয়ে দেওয়া গাদা সিলেবাস। ঘাড়ে ঘাড়ে পরীক্ষায় বছর ঘুরে যায়। ক্লান্ত হওয়ার সময় কোথায়?

আর যাঁরা এই এলিট-বলয়ের বাইরে? শপিং মলের বারো-চোদ্দো ঘণ্টা কাজ করেন যে কর্মী তাঁকে বসার একটা টুলও দেওয়া যায় না। দশ মিনিটের ডেলিভারিতে ক্লান্তির অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা সাপ্তাহিক অবিচ্ছিন্ন চব্বিশ ঘণ্টার সবেতন ছুটির কথা দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানালেও, কোনও আইনেই গৃহসহায়িকারা তা পেয়ে উঠছেন না।

দেশে দেশে এলিট কর্মীরা ডিজিটাল যুগের ‘অলওয়েজ় অন’ কর্মসংস্কৃতির বিরোধিতা করছেন। নানা দেশে আইন হচ্ছে, কাজের সময় পেরিয়ে গেলে আর ফোন, মেসেজ, ইমেলে উৎপাত নয়। আমাদের দেশেও এই কর্মজগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকার অধিকার নিয়ে আলোচনা সংসদ অবধি গড়িয়েছে। ক্লান্ত হওয়ার অধিকার কি তবে স্বীকৃতি পাবে?

আশার সঙ্গেই ভয়ও থেকে যায়। জর্জ বার্নার্ড শ সেই ১৯৩৫ সালের এক রেডিয়ো বক্তৃতায় (যা পরবর্তী কালে ফ্রিডম নামের রম্য রূপ পায়) সেই সময়ের আগুনখেকো বামপন্থীদের উপদেশ দিয়েছিলেন, সার্বিক দিনবদলের দূরগামী স্বপ্নপূরণের আগে একটু অবসরের অধিকার নিয়ে সরব হওয়ার। যাতে শ্রমিকটি একটা বই পড়তে পারেন, একটা ভাল নাটক, সিনেমা দেখার সুযোগ পেয়ে একটু চিত্তোন্নতির ফুরসত পান। সেই বিপ্লব এখন কোথায় জানা নেই, তবে বার্নার্ড শ এই ভরা একুশ শতকে এসে বেকুবই বনে যেতেন। ২০১৭-য় অধুনা অবসরজীবনের অন্যতম সঙ্গী নেটফ্লিক্স-এর তৎকালীন প্রধান রিড হেস্টিংস বলেছিলেন, নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোনও সংস্থা নয়, তা হল মানুষের ক্লান্তি ও ঘুম।

অবসরও কি তা হলে ক্লান্ত প্রাণকে দু’দণ্ড শান্তি দিতে রাজি নয়?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন