Barrackpore

কেন ওরা ‘অসামাজিক’, হিংস্র

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে নির্বাচনের সময় বাইরেও বোমা নিক্ষেপ বা বোমা উদ্ধার সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

Advertisement

শত্রুঘ্ন কাহার

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২২ ০৫:৫৭
Share:

সাধারণ মানুষ এক বিকৃত রাজনীতির শিকার। ফাইল চিত্র।

বাংলার রাজনীতি খবরে প্রায়ই শিরোনামে আসে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল। পঞ্চায়েত ভোটে আমডাঙায় বোমাবর্ষণ হোক, কিংবা পুরভোটের পরে ভাটপাড়া জুড়ে বোমা-গুলি বর্ষণের প্রতিযোগিতা, কাঁকিনাড়া রেললাইনের ধারে বল ভেবে বোমা তুলে বালকের মর্মান্তিক মৃত্যু, কিংবা টিটাগড়ের এক স্কুলে ত্রিকোণ প্রেমকে কেন্দ্র করে নাবালকের স্কুলের ছাদে বোমা নিক্ষেপ— সবই যেন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রায়ই দেখা যায়, দুই কিশোরের ঝগড়া শেষ অবধি দাঙ্গার রূপ নিচ্ছে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। শিশুদেরও শাসানির ভঙ্গিতে বলতে শোনা যায়, “আমি ভাটপাড়ার ছেলে।” সম্প্রতি বোমানিক্ষেপ কাণ্ডে ভাটপাড়ার নাম দেখে বহু মানুষ শিউরে উঠলেও, ভাটপাড়ার যুবসমাজের অধিকাংশের কাছে এমন খবর গর্বের অনুভূতি নিয়ে আসে, যা তাদের ভাবভঙ্গিতে সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়। এ কি শুধুই রাজনৈতিক জমি দখলের দ্বন্দ্ব, না কি এর পিছনে বৃহত্তর কারণ জড়িত রয়েছে?

Advertisement

এক দিকে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে একের পর এক চটকল বন্ধ হওয়ায়, বিরাট সংখ্যায় শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অতীতে চটকল বন্ধ হলে এই মজুররা নিজের রাজ্যে, নিজের গ্রামে ফিরে যেতেন, সেখানে কৃষি বা অন্য কোনও কাজে যোগ দিতেন। কিন্তু ক্রমশ তাঁরা শহরে স্থায়ী বাস শুরু করেছেন, ফলে সেই সম্বলটুকুও আর নেই। কর্মহীন মানুষগুলি সারা দিন ঘুরে বেড়ান, এবং অবশেষে রাজনৈতিক নেতাদের শরণাপন্ন হন। নেতাদের একাংশ কী ভাবে এই কর্মহীন শ্রমশক্তিকে নিজেদের বাহুবলী বাহিনীতে পরিণত করেন, তা অজানা নয়।

ভাটপাড়ার নানা বাড়ির রকে, বা রাস্তার মোড়গুলিতে ১৮ থেকে ২৫ বছরের ছেলেদের আড্ডার আসর। কেন এত ছেলে গল্প করে সময় কাটায়? এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে রয়েছে বাংলার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের বারুদের স্তূপে পরিণত হওয়ার আংশিক কারণ। চটকলে কর্মরত (বা কর্মবিচ্যুত) শ্রমজীবী পরিবারগুলির অধিকাংশের মাতৃভাষা হিন্দি। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মাতৃভাষায় (হিন্দি) শিক্ষা স্বীকৃত হওয়ায় এই সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়তে পারে। কিন্তু তার পর স্নাতক তথা স্নাতকোত্তর শিক্ষায় হিন্দি মাধ্যমে পড়ার সুযোগ পায় না। ফলে ১৮ বছর বয়স হতে না হতে বেশির ভাগ শ্রমজীবী পরিবারের ছেলেমেয়ে পড়া ছেড়ে দেয়। অল্প কিছু ছেলেমেয়ে দূরশিক্ষার মাধ্যমে স্নাতক স্তরের শিক্ষা শেষ করে। অধিকাংশেরই শুরু হয় আড্ডা-জীবন।

Advertisement

ক্রমশ এই কিশোররা বেকার যুবকে পরিণত হয়, পরিবার তাদের রোজগারের জন্য তাগাদা দিতে শুরু করে। নিজের পরিচিতি তৈরির তাগিদে অনেক যুবক পাড়ার মন্দির কমিটি, অথবা অন্য কোনও ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, এবং বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে। এমন ‘কাজ’ থেকে রোজগার বিশেষ হয় না, অথচ বয়স বাড়ে, পরিবারে কথা শুনতে হয়। এমন পরিস্থিতেতে তাদের কাছে প্রায় মসিহার মতো স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা হাজির হন। এই নেতারা চাকরি দেন না, কিন্তু অল্পবয়সি ছেলেদের যৎসামান্য হাতখরচ দেন। অথবা উৎসব বা নির্বাচনের সময় মদ, বিরিয়ানির ব্যবস্থা করে দেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাড়িতে মা-বাবা যতটা আদর করেন না, এই রাজনৈতিক নেতারা তার থেকে বেশি সমাদর করেন, প্রশ্রয় দেন। ফলে পরিবার তথা সমাজের নজরে যে নিষ্কর্মা, বাড়ির বোঝা, সেই ছেলেটা নিজের মূল্য খুঁজে পায় নেতাদের হিংস্র রাজনীতির মধ্যে। ক্রমশ তারা দলীয় রাজনীতির খেলার ক্রীড়নকে পরিণত হয়, এবং পাড়া জুড়ে দাদাগিরি শুরু করে।

গাড়ুলিয়া পুরসভার এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের দুই সন্তান যখন একই ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তখন সেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের হয়ে বোমা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অপরাধে পাড়ার এক যুবককে কয়েক মাস হাজতবাস করতে হয়। মজার বিষয় হল, সেই যুবকের বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর করা হয়েছিল যে পরিবারের পক্ষ থেকে, তার জামিনও করা হয় সেই পরিবারের পক্ষ থেকেই। শুধুমাত্র পরিবারিক রাজনৈতিক অন্তঃকলহের ফল ভোগ করতে হল একটি ছেলে ও তার পরিবারকে।

ম্যাক ডেভিসের রচিত ‘ইন দ্য গেটো’ গানে শুনি শিকাগোর দরিদ্র অঞ্চলে জন্মানো এক শিশুর কথা, যে কোনও সাহায্যের হাত না পেয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সেই ছেলে ভাটপাড়াতেও জন্মায়। সহায়তার হাত না পেয়ে, সম্মানের সঙ্গে বাঁচার সুযোগ না পেয়ে, এক ভয়ঙ্কর রাগী যুবকে পরিণত হয়। শুরু হয় অসামাজিক কাজ।

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে নির্বাচনের সময় বাইরেও বোমা নিক্ষেপ বা বোমা উদ্ধার সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর এর পিছনে স্থানীয় রাজনীতির পাশাপাশি বেকারত্ব, বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব, অর্ধ-শিক্ষা এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে, বা আরও স্পষ্ট করে বললে ভাটপাড়ায়, সাধারণ মানুষ আদতে এক বিকৃত রাজনীতির শিকার। বাইরের জগৎ ভাটপাড়ার যুবসমাজকে হিংস্র, অপরাধী বলে দেখে, তাদের অসহায়তার কথা কারও কাছে পৌঁছয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন