Hindi Language

ভাষার গুটিতে ক্ষমতার খেলা

২০১৩ সালে ‘ডিপার্টমেন্ট অব ল্যাঙ্গোয়েজ’ জানিয়েছিল, শেষ তিন বছরে হিন্দির প্রচারে তাঁরা সাড়ে তিনশো কোটি টাকা খরচ করেছেন।

Advertisement

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২২ ০৬:২৪
Share:

হিন্দির প্রভুত্ব।

ভারত নামে উপমহাদেশটি বার বার তার ক্ষমতাধরদের সঙ্কটে ফেলে। বর্তমান শাসকও যে সেই সঙ্কট অনুভব করছেন, বুঝতে অসুবিধে হয় না। আর তাই জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা থেকে আঞ্চলিক ভাষার জয়গান— প্রতি ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের নেতারা এক জাদুকাঠির আরাধনা করছেন, যাতে ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্রে ভরপুর এই উপমহাদেশকে একটা ক্ষমতার চাদরে ঢেকে দেওয়া যায়। আজ যখন ‘আঞ্চলিক ভাষা’র জন্য অশ্রু ঝরছে, ধরে নেওয়া যেতে পারে সেও এক শাসন-জাদুকাঠির খোঁজ।

Advertisement

কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এক কলকাতাবাসী বাঙালি বন্ধুর কাছে শুনছিলাম, তিনি নাকি প্রায়ই ‘হিন্দি ওয়ার্কশপ’-এ যোগ দেন, ভাল খাওয়াদাওয়া হয়, হাতেও কিছু মেলে। এমন নাকি অনেক অফিস, ব্যাঙ্ক ইত্যাদিতেই হয়। অদ্ভুত কাণ্ড। আমাদের যোগাযোগ রক্ষাকারী দু’টি ভাষার একটি হিন্দি হলে অপরটি ইংরেজি। যাঁরা ইংরেজি জানেন, তাঁদের হিন্দি শিখতে এবং বুঝতে বাধ্য করার এত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রয়াস কেন? মাতৃভাষা এবং ইংরেজি শিখলে বিশ্বের একটি বড় অংশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। হিন্দি কিন্তু সেই অর্থে নিজেও ভারতে সীমাবদ্ধ একটি আঞ্চলিক ভাষা। এক জন ভারতীয় নাগরিক এত ভাষার ভার বহন করতে অনিচ্ছুক হতেই পারেন। অন্য কোনও ভারতীয় ভাষা শিক্ষার প্রতি তাঁর আগ্রহ বা অনাগ্রহ দুই-ই থাকতে পারে। কেবল হিন্দি তো ‘দেশের ভাষা’ নয়, জাতীয় ভাষাও নয়, সব ভাষাই ‘দেশের ভাষা’। না কি, কেবল ভাষার অধিকার নয়, ভাষাভাষীর সংখ্যা (তাও আবার কষ্টকল্পিত এবং মিথ্যাগণিত দিয়ে তৈরি সংখ্যা) দিয়েই হিন্দি অন্য সব ভাষাকে হারিয়ে দিতে পারে?

দেশবাসী তো বটেই, খুব সচেতন ভাবে বিদেশের কাছেও হিন্দির প্রভুত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে। ২০১৩ সালে ‘ডিপার্টমেন্ট অব ল্যাঙ্গোয়েজ’ জানিয়েছিল, শেষ তিন বছরে হিন্দির প্রচারে তাঁরা সাড়ে তিনশো কোটি টাকা খরচ করেছেন। অর্থাৎ, আমাদের করের টাকার বড় অংশ খরচ হচ্ছে হিন্দি ভাষার প্রসারে (অন্য ভারতীয় ভাষা এই সুবিধা এই হারে পায় কি)। শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত জায়গায় ঘোষণা, সর্বত্র আমাদের এমন ঘেরাটোপে ফেলা হচ্ছে যে, হিন্দি শুনতে এবং বুঝতে আমরা বাধ্য হচ্ছি। আজকাল তো বিজ্ঞাপনী ফোনকল পর্যন্ত নির্বিকার ভাবে হিন্দিতে করা হয় এবং আশা করা হয় আমরা বাংলা বা ইংরেজির বদলে হিন্দিতেই উত্তর দেব। রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনের সময় দেখানোর বোর্ডে বাংলা না থাকলেও অভ্যাসবশত আমরা হিন্দি পড়ে ফেলি। এই ‘অভ্যাস’ কিন্তু আসলে সুপরিকল্পিত ভাবে আমাদের করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের নবীন প্রজন্মের অনেকেই হিন্দি বলাকে কিংবা বাংলার মধ্যে হিন্দি মিশিয়ে ভাষা বিকৃত করাকে এক ধরনের ‘কৃতিত্ব’ মনে করতে শুরু করেছে। তারা কি বুঝতে পারছে, এই ভাবেই তাদের জাতিসত্তাকে বিলীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে?

Advertisement

আজকাল বিজ্ঞাপনের ডাবিং-এ হিন্দির সঙ্গে ঠোঁট মেলাবার তাগিদে বাংলাকে ‘অদ্ভুত ভাষা’ হয়ে যেতে হয়। বাংলা ছবি দেখতে গিয়ে বাংলার প্রেক্ষাগৃহে আমাদের হিন্দিতে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ গাইতে হয়। খেলার ধারাভাষ্য হিন্দিতে শোনা ছাড়া গতি থাকে না। বাংলায় ব্যবসা করতে এসে রাজস্থানি ব্যবসায়ী জোর গলায় ‘শিঙাড়া’কে ‘সমোসা’ বলেন। আমরাও ‘সমোসা’ খেয়ে আপ্লুত হয়ে যাই। এ বার অপারেশন টেবিলে আমরা হিন্দি আশ্বাস বাণী শুনব, ডাক্তার প্রতিবিধান দেবেন হিন্দিতে। আমাদের ভাষাতেও নাকি এমনটা হবে। হওয়াটা কতটা যুক্তিসঙ্গত, এই প্রশ্ন পাশে সরিয়ে রেখেও বলা যায়, এই ‘নাকি’র মধ্যে ‘ফাঁকি’ থাকার সম্ভাবনা প্রবল।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, “হিন্দি প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, আঞ্চলিক ভাষার বন্ধু।” আমরাও তাই মনে করি। যে ভাষায় মুন্সি প্রেমচন্দের মতো মানুষজন সাহিত্য রচনা করেন, কেন তা অন্য ভারতীয় ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে? সেই ভাষাকে আগ্রাসনের কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চাইবেন তো কেবল লোভী মানুষরা! সমস্যা এই, আমরা এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারছি না, এমনকি সে ভাবে দাঁড়াতে চাইছিই না। কারণ কি এই যে অনায়াস অভ্যাসের গোলকধাঁধায় ফেলে হিন্দিকেই আমাদের ‘প্রথম ভালবাসার ভাষা’য় রূপান্তরিত করার জন্য জাল পাতা হচ্ছে? ‘বাংলা টাংলা’ না জানা অনেক শিক্ষার্থীর কাছে তো ইতিমধ্যেই বাংলা ‘দ্বিতীয় ভাষা’? অন্য ভাষা জানলে মাতৃভাষা শেখা যাবে না, এ তত্ত্ব তো অবৈজ্ঞানিক। হিন্দির উল্টো দিকে মাতৃভাষাকে দাঁড় করিয়ে তাকে ‘ভ্যানিশ’ করার ফাঁদ পেতেছে আমাদের সমকাল। আমরা কতখানি ভারতীয় আর কতখানি বাঙালি— এই প্রশ্নের মাঝখানে আমরা হিন্দি ভাষার অপপ্রবেশকে রুখে দিতে পারব কি না, সেখানেই আমাদের বাঙালি— এবং ভারতীয়— জাতিসত্তার পরীক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন