Amartya Sen

আজ যদি প্রতিবাদ না করি

কম-বোঝা সাধারণ মানুষ জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানে আসীন মানুষদের অন্য চোখে দেখেন— সেখানে যাঁরা প্রতি দিন প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের দূর থেকে সম্মান করেন।

Advertisement

অভিজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:২৭
Share:

অমর্ত্য সেন। ফাইল চিত্র।

জানি না, জেরুসালেমের ভূখণ্ডে শেষে জিশুর কতখানি জমি জুটেছিল, ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে তাঁকে সহবত শেখানোর জন্য কত বার প্যাপিরাসের পাতায় কালি ঢালার চেষ্টা হয়েছিল। এটুকু জানি যে, অমর্ত্য সেনের (ছবি) বিরুদ্ধে ছুড়ে চলা কাদা প্রতিনিয়ত বিদ্রুপ করছে আমাদের সুস্থ চিন্তাকে।

Advertisement

কম-বোঝা সাধারণ মানুষ জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানে আসীন মানুষদের অন্য চোখে দেখেন— সেখানে যাঁরা প্রতি দিন প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের দূর থেকে সম্মান করেন। পাড়ার ঝগড়ায় যে ভাষা ব্যবহৃত হয়, কাউকে ছোট করতে গিয়ে কিংবা ভয় দেখাতে গিয়ে যে ভাবে তাঁর বাড়ির বেড়া ধরে ঝাঁকুনি মেরে সমঝে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, এক জন বিশ্ববরেণ্য শিক্ষাবিদের সঙ্গে কি সেই আচরণ চলতে পারে? সমাজের সামগ্রিক এগিয়ে চলার অন্যতম শর্ত হচ্ছে ভাবনার ভিন্নতা হলেও তাকে সম্মান করা। আজীবন যিনি বিদ্যাচর্চায় ব্রতী, চার পাশের জগৎসংসারকে যিনি বহু প্রজন্মের অর্জিত বোধের প্রিজ়ম দিয়ে দেখতে সক্ষম, চলমান সমাজের নানা আঁধার দেখে অন্যদের চেয়ে তিনি বেশি আলোড়িত হবেন, তা স্বাভাবিক। কারণ, সেই আঁধারের প্রকৃত স্বরূপ দেখার ক্ষমতা আজীবনের অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি অর্জন করেছেন। এমন এক জন মানুষের কথার মধ্যে অপছন্দের ভাষা থাকলেও ধৈর্য ধরে তা শোনার এবং তাঁকে বলার জায়গা করে দেওয়াটাই সমাজের এগিয়ে চলার হরফ।

শান্তিনিকেতনে এখন যা ঘটছে, তা ঠিক এর উল্টো। বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত আমার সুরে সুর মেলাচ্ছেন না বলে তাঁকে কর্দমাক্ত করার জন্য যদি প্রতিষ্ঠান উঠেপড়ে লাগে, তা হলে চিন্তার মূল পথই অবরুদ্ধ হয়। লড়াই, সংঘর্ষ যদি হতেই হয়, তা হলে তা বিপরীত চিন্তার ও যুক্তির প্রসারের মধ্যে দিয়েই হোক না কেন! যে মানুষটিকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা, যাঁকে দেখে প্রতিষ্ঠান ভয় পাচ্ছে চলমান অগ্নিবলয়ের মতো, তিনি তো সবচেয়ে বেশি বলে চলেছেন বিতর্কের অঙ্গনগুলোকে প্রসারিত করার সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা। যে কোনও সমাজের অগ্রসর হওয়ার একমাত্র ভাষা যে সহিষ্ণুতা, তা তো তিনিই বার বার তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়, বক্তৃতায়, ভাবনায়। সেই চিন্তার মাঠেই লড়াইটা হোক না কেন?

Advertisement

আশা করি, এই মুহূর্তে সবার এটাই কামনা যে, সামগ্রিক শুভবুদ্ধির জাগরণের মধ্যে দিয়ে দ্রুত জ্ঞানতাপসের দিকে কাদা ছোড়া বন্ধ হবে। বিকৃতির উল্লাসে হাততালি পড়লে তা হবে আত্মহানিকর, এটা সবার মাথায় রাখা দরকার। ভাবনার পথের এবং ব্যবহারিক জীবনের ক্ষয়গুলো এক দিনে ধরা পড়ে না। তা সমাজের এবং সংস্কৃতির কাঠামোটাকেই উইপোকার মতো ফোঁপরা করে তোলে। চিন্তাকে বাক্সবন্দি করতে চায়। সেই বিপদের কথা মাথায় রাখা ভাল।

অমর্ত্য সেনের মতো চিন্তাবিদরা তাঁদের জ্ঞান, অনুভূতি, ভিতর ও বাইরেটা দেখতে পাওয়ার ক্ষুরধার ক্ষমতা দিয়ে সমাজের ভাবনাকে ঋদ্ধ করবেন, সমাজের কাছে এ তো আশীর্বাদস্বরূপ। তাঁরা প্রচলিত ব্যবস্থার পক্ষে বলছেন, না বিপক্ষে, তা তাঁদের ভাবনার এবং কাজের বিশ্লেষণের মাপকাঠি হতে পারে না। বিভিন্ন রাজনৈতিক বর্ণের প্রতি আনুগত্যে অভ্যস্ত ভাবনার ছাঁচে ফেলে সমস্ত ভাবনাকে দেখার প্রবণতা এ ক্ষেত্রে প্রায়ই বাধ সাধে। ‘উনি এ কথা বলেছেন, অতএব উনি আমাদের নন, ওদের’— এ ভাবে রং বিচারের অভ্যাসটি ত্যাগ করে কোনও কথাকে সেই কথার গুরুত্ব অনুসারে বিচার করার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। যে শাসক মুক্তচিন্তার, বিপরীত বিচারের বিকাশের জায়গা করে দেন, তিনিই হন কালজয়ী।

সমস্যাটা এখানেই। একদেশদর্শী এবং একচোখা শাসক চিন্তাশীল নাগরিক চান না— চান মোসাহেব, অথবা তোতাপাখি। সেই বোধহীন, স্বার্থসর্বস্ব আনুগত্যের অন্যতম অভিব্যক্তি হল বিরুদ্ধবাদী স্বরের প্রতি ব্যক্তিগত কুৎসা। ইতিহাসেও এর অনেক উদাহরণ আছে। ঠিক এ রকম পরিপ্রেক্ষিতেই একশো বছর আগে আইনস্টাইনকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল জার্মানিতে। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি হিটলারের আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ এবং ইহুদি বিনাশের আর্য ঐতিহ্যের তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে জার্মানি ছাড়তে হয়।

এ দেশের রাজনীতির আঙিনায় লেখাপড়া করা, শেখানো বুলি না-আওড়ানো, নিজস্ব চিন্তায় ভাস্বর মানুষেরা এখন আর আসেন না বলে মাঝেমধ্যেই অনুযোগ শোনা যায়। অধ্যাপক সেনের বিরুদ্ধে যে অবিশ্বাস্য কদর্য আক্রমণ বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফে চলছে, সে কাদা তাঁর গায়ে লাগবে না— তিনি এই ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে। কিন্তু আজ আমরা যদি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ না করি, ভবিষ্যতে কোনও বিদ্বান মানুষ রাজনীতির পরিসরে কথা বলার সাহস করবেন কি? যদি তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, ক্ষতি কিন্তু তাঁদের হবে না— ক্ষতি হবে সমাজের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন