গণরাজনীতির নতুন রূপ
Duare sarkar

দুয়ারে সরকার: জনমুখী প্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকার বিবর্তন

অভিনবত্বের কথা বলছি অন্য দিক থেকে। ভেবে দেখার ব্যাপার, জনস্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে এই ব্যাপক উদ্যোগের জন্ম।

Advertisement

রণবীর সমাদ্দার

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২১ ০৫:৩৬
Share:

দুয়ারে সরকার হাজির হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের বিদ্রুপও শুরু হয়েছে, তবে কি নির্বাচনের দোরগোড়ায় মনে পড়ল, সরকারের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছতে হবে? বিদ্রুপ, সমালোচনায় মাথা ঘামালে এগোনো যায় না, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিদ্রুপে বিচলিত হলে তো কাজই অসম্ভব। তাই গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প বসেছে। পুরসভার ঘরে, প্রাঙ্গণে, ইস্কুলের চত্বরে, খোলা মাঠে শিবির বসেছে। রোগের থেকে বাঁচার জন্য মুখ ঢাকা দিয়ে, লাইনে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সুবিধা নিতে নাম লিখিয়েছেন। জাতিশংসাপত্রের আবেদন জানিয়েছেন। অন্যান্য সমস্যাও সরকারকে জানিয়েছেন। মহিলাদের উপস্থিতি বিপুল হারে হয়েছে। কারণ, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড হবে পরিবারের কোনও মেয়ের নামে, যার সুবাদে সমগ্র পরিবার স্বাস্থ্যবিমার সুযোগ পাবে। সরকার আজ আপনার, আমার, পাড়া প্রতিবেশীর দুয়ারে উপস্থিত।

Advertisement

ক্যাম্প বসিয়ে প্রত্যক্ষ ভাবে গ্রামের গভীরে, ছোট শহরে, পাড়ায় পাড়ায় নিয়ে যাওয়ার ধারণা অভিনব লাগলেও এর ঐতিহ্য বহু পুরনো। ঔপনিবেশিক আমলে জমি জরিপ এবং বন্দোবস্তের কাজে গ্রামে ওই রকম শিবির বসত। এক এক সময় খাদ্য বিতরণ, কাজের জন্য কার্ড বিলি, গণস্বাস্থ্যের অংশ হিসেবে টিকা কর্মসূচি— এই সবের জন্য সরকারের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি পাওয়া যেত গ্রামে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যাওয়া এলাকায়। লোকেরা জানত, সরকার আছে। সরকারও জানতে পারত, লোকেরা আছে। তাদের কাছে যেতে হবে।

নির্বাচন-কালে সরকারকে আরও জনমুখী করার ভাবনায় জোয়ার এলে আপত্তির কারণ নেই। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এবং সংস্কার শুরু হলে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবসর থাকবে নির্বাচনোত্তর আবহে। এবং তাকে বন্ধ করলে জনসাধারণ নিজস্ব রাজনৈতিক বিচারে যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার, করবেন। সংস্কার নিয়ে অত ভাবলে সংস্কার শুরু হয় না।

Advertisement

অভিনবত্বের কথা বলছি অন্য দিক থেকে। ভেবে দেখার ব্যাপার, জনস্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে এই ব্যাপক উদ্যোগের জন্ম। স্বাস্থ্যসাথী নামক স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু রাজ্য জুড়ে শিবির বসিয়ে সমগ্র প্রশাসনিক বাহিনী নামিয়ে লক্ষ লক্ষ নরনারীর স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা, এই উপলক্ষে বাস্তবায়িত করা ‘দুয়ারে সরকার’-এর ধারণা— এর থেকে কি কিছু শেখার নেই? আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বর্গাচাষির নাম রেকর্ড করার যে উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গ দেখেছিল, এই কর্মোদ্যোগ কি তার অনুসারী নয়, এবং এর মহিমা কম কিসে? অন্য আর এক দিক হল, মেয়েদের নামে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে পরিবারের নাম নথিভুক্ত করা। এবং এ সব হচ্ছে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়, শহরে গঞ্জে এবং গ্রামে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রসার ঘটিয়ে। অবশ্যই এখনও অনেক কিছু বাকি। অনেক ফাঁকিও আছে। কিন্তু কোনও সরকার কি কখনও বলতে পারে, আমি জনদুয়ারে সর্বদা উপস্থিত? সাহায্য, নিরাপত্তা, উন্নতি, এবং দুঃখের প্রতিটি প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তোমরা সব সময়ে আমায় পাবে? শাসিত এবং প্রশাসকের সব পার্থক্য ঘুচে যাবে? আত্মশাসনের আদর্শেও শাসিত ও প্রশাসকের দূরত্ব এবং পার্থক্য থাকে। জনদুয়ারে শাসকের পৌঁছে যাওয়া হল এক আদর্শ, যার পিছনে সরকারকে সর্বদা ছুটতে হবে। এ এমন এক আদর্শ, যা কখনও সম্পূর্ণ লব্ধ হবে না, কিন্তু যা না থাকলে জনমুখী প্রশাসনও থাকবে না।

পুরনো রেওয়াজের সঙ্গে দুয়ারে সরকারের বাস্তবতার একটা পার্থক্য আছে। এর আগে বাংলায় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ এবং পার্টি সংগঠন প্রশাসন এবং জনসাধারণের মাঝের পার্থক্য মেটানোর চেষ্টা করতেন, দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করতেন। নানা কারণে সেই প্রক্রিয়ার সুনাম নষ্ট হয়েছে। মধ্যস্থ শক্তির যাথার্থ্য কমে গিয়েছে। যেন লোকে চায়, সরকার আমার কাছে এসে সরাসরি আমার কথা শুনুক। যে মানুষ যত প্রান্তিক অবস্থানে, যত অধোবর্গীয় তার অবস্থান, ততই তার এই প্রত্যক্ষ প্রশাসন, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা। তাই প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে পুরনো সরকারগুলো যে-সব কমিশন বসিয়েছিল, পাঁজা পাঁজা রিপোর্ট বেরিয়েছিল কেন্দ্রে এবং এই রাজ্যে— তার চিন্তাধারা এবং অধোবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রশাসনিক উদ্যোগ এবং পরিবর্তন, এই দুই চিন্তার চরিত্র, যুক্তি, এবং বিন্যাস স্বতন্ত্র।

এ তো শুধু একটা উদ্যোগ নিয়ে কথা। ‘পাড়ায় সমাধান’, ‘দিদিকে বলো’, ‘পথশ্রী’, ‘রূপশ্রী’, ‘কন্যাশ্রী’— এই রকম সরকারি উদ্যোগ বাংলার প্রশাসনকে যে দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, প্রশাসন বিশেষজ্ঞেরা সে নিয়ে পরে চর্চা করবেন। কিন্তু এটুকু বলা যায় যে, রাজনীতিতে তার ছাপ থেকে যাবে।

এই ধরনের উদ্যোগ থেকে আসে ক্ষমতার এক ধরনের প্রসার, যার নাম হিসেবে ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ শব্দটি ঠিক ব্যবহার করা যায় না। ক্ষমতা কোনও একক কেন্দ্র থেকে এখানে বিচ্ছুরিত হচ্ছে না। ক্ষমতাকেন্দ্র বলে যদি কিছু থাকে, তা রয়েছে ক্ষমতা প্রয়োগের এই রীতির মধ্যে, যা ক্রমাগত প্রশাসন এবং এক অসঙ্ঘবদ্ধ জনতার সেতুবন্ধন ঘটাচ্ছে। এবং এই সেতুবন্ধনের মধ্য দিয়ে জনতা এক সঙ্ঘবদ্ধ জনসাধারণের রূপ নিচ্ছে। প্রশাসনকে বাদ দিয়ে এই অসঙ্ঘবদ্ধ জনতা অসহায়। মুখ্যমন্ত্রী যে প্রশাসনিক বৈঠক করতে থাকেন জেলায় জেলায়, যে ধরনের আলোচনা হয়, যে ধরনের আমলা, কর্মিবৃন্দ, এবং নির্বাচিত নাগরিকদের সমাবেশ হয় এই সব বৈঠকে— এ হল জনমুখী প্রশাসন তৈরি করার নিরন্তর প্রয়াস। এই পদ্ধতির ভাল মন্দ দুই-ই আছে, সীমা আছে, কিন্তু জনপ্রিয়তাবাদী প্রশাসনিক উদ্ভাবনার সম্ভাবনাও অনেক।

এক সময় শোনা যেত উন্নয়নমূলক প্রশাসনের কথা। বাংলায় আজ যা হচ্ছে, তাকে সেই ছকে ফেলা যাবে না। উন্নয়নমূলক প্রশাসন-পদ্ধতি থেকে কিছু উপাদান এখানে সংগৃহীত হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রত্যক্ষ শাসন এবং গণতন্ত্রের ভাবনা। মৌলিক কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, উন্নয়ন উপর থেকে হবে না। উন্নয়ন কল্পনাতেও অধোবর্গীয় উপস্থিতি প্রয়োজন। এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হল,
ক্রমাগত শাসনকে জনদুয়ারে নিয়ে যাওয়া। প্রশাসনিক সংস্কারের প্রেক্ষাপটে এই বাস্তবায়নের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।
কিন্তু ‘দুয়ারে সরকার’ প্রসঙ্গে প্রশাসন সম্পর্কে জনবাদী বা জনপ্রিয়তাবাদী ভাবনার তাৎপর্য বোঝা প্রয়োজন।

দুয়ারে সরকার কি আগে ছিল না? আবার এই প্রশ্ন থেকে শুরু করা যাক। আগে সাধারণ মানুষ সরকারের উপস্থিতি টের পেতেন, যখন সিপাইসান্ত্রি পেয়াদা দুয়ারে কড়া নাড়ত, সমন ধরিয়ে দিত, হাজিরার নোটিস ধরাত। এখনও সে সব চলে। পাশাপাশি জনকল্যাণ এবং জননিরাপত্তার আশ্বাস দুয়ারে গিয়ে দিতে হবে, এই ধারণা এই বাংলায় সহসা আসেনি। শিক্ষাপ্রসার এবং খাদ্যনিরাপত্তার জোগান স্বাস্থ্যসাথী কর্মসূচির প্রসারের প্রেক্ষাপট রূপে কাজ করেছে। আমরা জানি, জেলায় জেলায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্কুল তৈরি হয়েছে। সর্বস্তরে ছাত্রছাত্রীর প্রবেশ সংখ্যার অভাবনীয় বৃদ্ধি ঘটেছে। একটু একটু করে শিক্ষার সহায়িকা সামগ্রী বেড়েছে, তা মিড-ডে মিল হোক বা জুতো, জামাকাপড়, ছোট ল্যাপটপ, বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাড়ি। একই ভাবে কৃষির প্রসার ঘটেছে। খাদ্যশস্য এবং আনাজ উৎপাদনে বাংলা অনেক এগিয়েছে। রাজ্যের মোট বার্ষিক উৎপাদন একই ভাবে বেড়েছে অনেকগুণ।

এর পিছনে কাজ করেছে কোনও পরিকল্পনা কমিশন বা যোজনা বোর্ড নয়, বরং অর্থনীতি সম্পর্কে এক ধরনের সহজ বুদ্ধি। কেতাবি ভাষায় যাকে বলা যায় এক ধরনের অর্থনীতিকেন্দ্রিক কমন সেন্স। ছোট মাঝারি চাষির উৎপাদন এবং ছোট মাঝারি ব্যবসা এবং শিল্পের প্রসার, লক্ষ লক্ষ অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষের একটু একটু করে অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য, পরিকাঠামোর প্রসার এবং উন্নতি শিক্ষাপ্রসারে এবং খাদ্যনিরাপত্তায় সাহায্য করেছে— পুঁথিগত প্রশাসনিক সংস্কার-বিজ্ঞান ছাড়াই।

এই বিশেষ এবং প্রত্যক্ষ কর্মপদ্ধতির ক্ষেত্রে দু’টি দিক লক্ষণীয়। এক, এই বিশেষ উদ্যোগকেন্দ্রিক প্রশাসনের ফলে অচিরে সাধারণ প্রয়োজনসাধন, এবং পরিকল্পনার কাজের প্রতি মনোযোগ কমতে পারে। কৃষক মান্ডি, পানীয় জল সরবরাহ, এ সব বিষয়ে প্রশাসনিক দুর্বলতা আজ প্রকট। দুই, পরিকল্পনা না থাকলে এই প্রশাসনিক পদ্ধতি শেষে কোনও মতে আগুন নেবানোর মতো হয়ে দাঁড়ায়, চিরকালই যা আগুন নেবাতে ব্যস্ত থাকবে। শহরের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের উপর এই কর্মপদ্ধতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে লক্ষণীয় ভাবে।

বাংলার সরকার এগোচ্ছে এই ভাবে। ভাল মন্দ মিশিয়ে। নিরাপত্তা, আশ্বাস, জনকল্যাণ, এবং একটু একটু করে এগোনোর ধৈর্য— এই হল জনবাদী প্রশাসনের সম্বল। বিশ্বায়নে আগ্রাসনের সামনে অধোবর্গের প্রতিরোধ নানা ভাবে ঘটছে। অধোবর্গের নিজস্ব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভাবনার সমালোচনা করার আগে তার স্বরূপ বোঝা দরকার। আর তার জন্য লাগে অধোবর্গের রাজনীতির প্রতি ন্যূনতম সম্মান।

শেষে একটা প্রশ্ন তুলতে চাই। বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে ক্রমাগত সরকারি কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে রাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রয়োজন, তা আসছে কোথা থেকে? যা আমরা কেউ প্রকাশ্যে বলতে চাই না, তা হল ব্যক্তির ভূমিকা এই ধরনের প্রশাসনে। এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির নেতৃত্ব, ব্যক্তিকে ঘিরে ক্ষমতা সংহত হওয়ার চেষ্টা, ব্যক্তিকে ঘিরে প্রশাসনিক উদ্যোগ। আধুনিকতামনস্ক মানুষের, বিশেষত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের রুচিতে এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কারণে আঘাত লাগে। বাস্তবতা মানতে অসুবিধে হয় শিক্ষিতসমাজের বিশেষত, পুরনো দিনে বিভিন্ন দেশে, আমাদের দেশেও এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কদর্য রূপ আমরা দেখেছি। কাজেই অস্বস্তির কারণ আছে। এক এক সময়ে অধোবর্গের রাজনীতি এমন ব্যক্তিকে ঘিরে গড়ে ওঠে। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে, তার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক হয়েই গণরাজনীতিকে এগোতে হয়। দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিরোধের এই বৈশিষ্ট্যসমূহের সব কিছু শিক্ষিত সমাজের পছন্দ হয় না। তার কারণ বোঝা কঠিন নয়।

তবে আজ এ-দেশে দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদ, যা কর্পোরেট পুঁজির শাসন শক্তিশালী করতে চায়, তার প্রধান বিরোধী রূপে হাজির এই জনকল্যাণকামী জনপ্রিয়তাবাদ, বা জনবাদী রাজনীতি। নির্বাচনকে উপলক্ষ করে রাজনৈতিক সংগ্রামের তীব্রতা প্রকাশিত হচ্ছে নতুন প্রশাসনিক উদ্ভাবনায়। প্রশান্ত কিশোরের নির্বাচনী মন্ত্রণা যদি এই সব উদ্ভাবনাকে সাহায্য করে থাকে, মন্দ কী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন