কী পেলে আনন্দ হবে, ক্লান্ত মগজকে সে কথা জানাচ্ছে অ্যাপ
Online Delivery Applications

সুখের হোম ডেলিভারি

শিশিরকে উত্তর না দিয়ে ঋতুপর্ণা শিবুদাকে বলল, “ডেলিভারি চার্জ বাঁচাতে এক সঙ্গে একগাদা অর্ডার দেওয়া, বিচক্ষণ কাজ?”

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৪৯
Share:

অনলাইন শপিং-এ দু’বার ডোপামিন ক্ষরণ হয়। প্রতীকী ছবি।

মুখটা তোম্বা করেই দু’আঙুলে মাংসের টুকরোটা ভেঙে মুখে দিলেন শিবুদা। সেকেন্ড দুয়েক স্থির, তার পর মুখ প্রসন্ন হল খানিক। তুলতুলে নরম মাংস, শিশির রেঁধেছেও দেবভোগ্য। গোপালের দোকান থেকে আজ তপেশরা শিবুদাকে এক রকম কিডন্যাপ করেই নিয়ে এসেছে শিশিরের বাড়িতে। রাত সাড়ে বারোটায় আর্জেন্টিনার খেলা দেখবে, তার আগে মাংস-ভাত। শিবুদা ফুটবল দেখেন না। ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসতে বাধ্য হওয়ার প্রতিবাদ হিসাবে এত ক্ষণ একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। খাসির মাংসের কল্যাণে তাঁর মৌনভঙ্গ হল। বললেন, “এ যাত্রা মাফ করে দিলুম, যাঃ। এই মাংস না খেলে শেষে যমরাজের সামনে উত্তর দিতে পারতাম না।” শিশিরের বৌ ঋতুপর্ণা শিবুদার বাটিতে আর এক হাতা মাংস দিল। দেখেও না দেখার ভঙ্গি করে আলগোছে বাটিটা টেনে নিলেন শিবুদা।

Advertisement

“হ্যাঁ রে, ফ্রিজে কোল্ড ড্রিঙ্ক আছে?” আঙুল চাটতে চাটতে প্রশ্ন করল সূর্য।

শিশির ঘাড়ে নেড়ে না বলেই ফোনটা টেনে নিল, “দাঁড়া, আনিয়ে নিচ্ছি। এখন তো দশ মিনিটে ডেলিভারি দিয়ে যায়।” তার পর ঋতুপর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাতের খেলা, শেষ হতে হতে আবার খিদে পেয়ে যাবে, বুঝলে। আরও কিছুমিছু আনিয়ে নিই, এক ডেলিভারি চার্জে মিটে যাক।”

Advertisement

শিশিরকে উত্তর না দিয়ে ঋতুপর্ণা শিবুদাকে বলল, “ডেলিভারি চার্জ বাঁচাতে এক সঙ্গে একগাদা অর্ডার দেওয়া, বিচক্ষণ কাজ?”

নলির হাড় থেকে বোনম্যারোটা সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে শিবুদা বললেন, “তোমায় বিয়ে করা ছাড়া আর কখনও কোনও বিচক্ষণতার পরিচয় শিশির দিয়েছে বলে তো শুনিনি। অবিশ্যি, এখন যেটা করল, সেটা ইর‌্যাশনাল বটে— কিন্তু দুনিয়াভর লোকে নিয়মিত এই অযৌক্তিক কাজটা করে চলেছে। কিছু গবেষণা বলছে, অল্প ডেলিভারি চার্জ থাকলে, অথবা একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের কম কেনাকাটায় ডেলিভারি চার্জ দিতে হলে তাতে আসলে কোম্পানির বিক্রির পরিমাণ বাড়ে।” কথা শেষ করে আবার মাংসে মনোনিবেশ করলেন শিবুদা।

“কেন, সেটা বলবেন, না কি সাসপেন্স?” ফুট কাটল তপেশ। শিবুদা বললেন, “খেতে খেতে বেশি কথা বলতে নেই, আমার গুরুর বারণ আছে।”

ডোরবেল বাজল। শিশির উঠে গেল ডেলিভারি নিতে। সূর্য বলল, “বারো মিনিট।”

খাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে ইজ়িচেয়ারে লম্বা হলেন শিবুদা। সিগারেট ধরালেন একটা। তার পর ঋতুপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডেলিভারি চার্জ জিনিসটা, বুঝলে, অতি বিরক্তিকর— যা কিনছি, তার দামের উপর আরও কিছু বাড়তি টাকা দিতে বাধ্য হওয়া। আমাদের মন এটাকে দেখে ক্ষতি হিসাবে। লস অ্যাভার্শন, অর্থাৎ ক্ষতি এড়াতে চাওয়া আমাদের একেবারে মজ্জাগত প্রবৃত্তি। শিশিরও তাই করল— কেনাকাটার পরিমাণ বাড়িয়ে দিল, যাতে গড়ে ডেলিভারির খরচ কমে। আটশো টাকার জামা কিনে চেক-আউটের সময় হাজার টাকার উপরে কেনাকাটায় ফ্রি ডেলিভারি দেখে আরও ছ’শো টাকার সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটা জামা তুমি কখনও কেনোনি, বলো দিকি?”

শিশির বৌয়ের দিকে তাকিয়ে সব দাঁত বার করে হাসল। ঋতুপর্ণা ভ্রুকুটি করল, যেমন ভ্রুকুটির সামনে হাজার হাজার জেতা তর্ক স্বেচ্ছায় হেরেছে ছেলেরা, আজীবন। এ সব দাম্পত্য খুনসুটি তপেশের চোখে পড়ে না। সে বলল, “যে জিনিস আজ না হোক কাল লাগবেই, সেটা যদি হাতের নাগালে পাওয়া যায়, তা হলে কিনে রাখতে ক্ষতি কী?”

“কাজে যে লাগবে, সেটা যদি অ্যাপ খোলার পর মনে পড়ে, তা হলে বিলক্ষণ ক্ষতি,” শিবুদা উত্তর দিলেন। “কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল কার্টে রাখলে ‘ইউ মে অলসো লাইক’ বলে যে পটেটো চিপস আর চানাচুরের লিঙ্ক আসে, সেটা তো এমনি নয়। লক্ষ লক্ষ ক্রেতার তথ্য বিশ্লেষণ করে কৃত্রিম মেধা জানে, কোন জিনিসটার সঙ্গে কোনটা যায়— ক্রেতারা কোন জিনিসগুলো এক সঙ্গে কেনে। অ্যাপে ঢোকার সময় যে জিনিসটার আদৌ কোনও চাহিদা ছিল না, হাতের কাছে, থুড়ি, চোখের সামনে এগিয়ে দিলে সেটার জন্যই চাহিদা তৈরি হয়। সুপার মার্কেটে চেক-আউট বে-তে হরেক টুকিটাকি জিনিস রাখা থাকে, দেখবি— চকলেট, চিউয়িং গাম, আরও হাজার হাবিজাবি— যেগুলো আদৌ কেনার প্ল্যান ছিল না, হাতের কাছে সেগুলো পেয়ে আমরা হামেশাই কিনে ফেলি। এটারই অনলাইন ভার্সান হল, ‘পিপল অফেন বাই টুগেদার’ বলে তোর কিনতে চাওয়া জিনিসটার সঙ্গে আর একটা পণ্য দেখিয়ে দেওয়া। শুধু চোখের সামনে নিয়ে এসে তার চাহিদা তৈরি করে দেওয়া।”

“গোটা কুইক কমার্সের গল্পটাই তো তাই, শিবুদা। এই ব্যবসা আরম্ভ হওয়ার আগে কেউ কখনও মুদিখানার মাল পনেরো মিনিটের মধ্যে ডেলিভারি চাই বলে দাবি করেছিল? কিন্তু, চাহিদা তৈরি করে তো দিল— যে সব ই-কমার্স কোম্পানি এখনও মুদিখানার জিনিস ডেলিভারি দিতে এক দিন সময় নেয়, তাদের ব্যবসা তো লাটে ওঠার জোগাড়,” শিবুদার কথার পিঠে উত্তর দিল সূর্য।

“সে আর বলতে! এ বছরের গোড়ার দিকে রেডসিয়ার বলে একটা মার্কেট রিসার্চ ফার্ম জানিয়েছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতে কিউ-কমার্সের ব্যবসা বাড়বে পনেরো গুণ,” বললেন শিবুদা। “কিন্তু, কোথায় বাড়বে, আসল গল্পটা লুকিয়ে আছে সেখানে। রেডসিয়ারের রিসার্চ বলছে, কিউ-কমার্সের ব্যবসা এখন মূলত টায়ার ওয়ান শহরে— দেশের আটটা বৃহত্তম শহরে— সীমিত, এবং আগামী কিছু বছরও সেখানেই থাকবে। ক্রেতারা প্রধানত উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত— সেটাও পাল্টাবে না। এখন কিউ-কমার্সের সত্তর শতাংশ অর্ডার হল টপ-আপ পণ্য— স্টক-আপ বা মাসকাবারি মাল নয়, সেটা এখনও পাড়ার মুদিখানা, সুপার মার্কেট বা ই-কমার্স থেকেই কেনে লোকে— টপ-আপ হল এই শিশিরের মতো কিছুমিছু কেনাকাটা। যদিও রিসার্চ বলছে, এটা পাল্টাতে পারে— যারা কিউ-কমার্সের খদ্দের, তারা অদূর ভবিষ্যতে সম্ভবত মাসকাবারি মালও এখান থেকেই কিনবে। এ বার ভাব, নতুন বাজার তৈরি না করে, এমনকি নতুন অর্থনৈতিক শ্রেণির মধ্যেও তেমন ভাবে ঢুকতে না চেয়ে তিন বছরে পনেরোগুণ ব্যবসা বাড়ানোর অর্থ ঠিক কী।”

“টায়ার ওয়ান শহরের বাইরে যাওয়ার একটা স্ট্রাকচারাল প্রবলেম আছে না?” প্রশ্ন করল ঋতুপর্ণা। তার পর নিজেই বলল, “কিউ-কমার্সের ব্যবসার মডেলটা তো হাইপার লোকাল— এক একটা ডার্ক স্টোর থেকে দু’তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বাইরে ডেলিভারি যায় না। টায়ার ওয়ান শহর ছাড়া এইটুকু গণ্ডিতে এত ক্রেতা পাবে কোথায়?”

“তুমি যে বিজ়নেস ম্যানেজমেন্ট পড়াও, সেটা বোঝা যাচ্ছে,” ঋতুপর্ণার যুক্তি মেনে নেন শিবুদা। “কিন্তু, এই মডেলটার মধ্যে থেকেই ভাবো, এই যে তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধ, সেটুকুতে থাকা মানুষের মধ্যে থেকেই তিন বছরে পনেরোগুণ চাহিদা বাড়িয়ে নেওয়া মানে, কী বিপুল পরিমাণ লেটেন্ট ডিমান্ড— প্রচ্ছন্ন চাহিদা— রয়ে গিয়েছে! এই ব্যবসার ক্রেতারা এসেনশিয়ালি উচ্চবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মানে যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকুই কেনার বাধ্যবাধকতা এই ক্রেতাদের নেই। এমনিতে, মুদিখানার জিনিস কেনার তো একটা সীমা আছে— তোমার যত টাকাই থাক, মাসে আর ক’প্যাকেট কর্নফ্লেকস খাবে? তা হলে এই ক্রেতাদের না-মেটা চাহিদাটা কিসের? রিসার্চ বলছে, এই ক্রেতাদের বেশির ভাগই তুলনায় তরুণ, ব্যস্ত, অনলাইন শপিং-এ অভ্যস্ত। ভেবে দেখলে, এদের আসল চাহিদা হল সুবিধার— ঘরে বসে জিনিস পাওয়ার; যেটা ইচ্ছা করছে, অথবা অ্যাপের সাজেশন যে ইচ্ছা তৈরি করে দিচ্ছে, সেটাই পাওয়ার; এবং, তৎক্ষণাৎ পাওয়ার। যাকে বলে, ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন।

“মানুষের মাথা যখন ক্লান্ত থাকে, তখন ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশনের চাহিদা বাড়ে। ভবিষ্যতে ক্ষতি হবে কি না, অথবা আমার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সঙ্গে এই চাহিদা সঙ্গতিপূর্ণ কি না, তা না ভেবেই তৎক্ষণাৎ আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এ বার ভাবো, কিউ-কমার্সের বেশির ভাগ খদ্দের কারা— টায়ার ওয়ান শহরে থাকা অতি ব্যস্ত উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত— অর্থাৎ, যাদের চব্বিশ ঘণ্টা কাটে পেশাদার চাপে। তারা ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন চাইবে, এতে আশ্চর্য কী? নিউরোইকনমিকস-এর গবেষণা বলছে, শপিং করলে আমাদের মগজে ডোপামিন ক্ষরণ হয়— যে নিউরোট্রান্সমিটার আমাদের মধ্যে আনন্দ, সন্তুষ্টির অনুভূতি তৈরি করে। প্রচুর চাপ বা দুঃখের মধ্যে থাকা কোনও মানুষ শপিং করলে তার চাপ কমে, ডোপামিনের কারণেই। অনলাইন শপিং-এ দু’বার এই ডোপামিন ক্ষরণ হয়— এক বার ‘বাই নাউ’ বাটনটাতে ক্লিক করার সময়, আর দ্বিতীয় বার জিনিসটা ডেলিভারি পাওয়ার সময়। কিউ-কমার্স এই দু’বারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কমিয়ে দেয় সাংঘাতিক ভাবে। ডোপামিন ক্ষরণের নেশা হয়ে গেলে ক্ষণে ক্ষণেই কিউ-কমার্স অ্যাপ খোলা ভিন্ন উপায় নেই— কেনাকাটার আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। ফুরিয়ে গেলেই ফের নতুন আনন্দ কিনতে হয়।”

“এর জন্যই বলি, ফুটবল দেখুন। এই যে মেসি খেলতে নামবে, গোল দেবে, সেটা দেখার মধ্যে যে আনন্দ, কেনাকাটার সাধ্য আছে তার সঙ্গে পাল্লা দেয়?” টিভি চালাতে চালাতে বলল তপেশ।

“আমি ঘুমোলাম। তার আনন্দের কাছে তোর মেসিও তুশ্চু। খেলা শেষ হলে আমায় বাড়িতে নামিয়ে দিতে ভুলিস না কিন্তু,” হাত ভাঁজ করে চোখের উপরে চাপা দেন শিবুদা। কোল্ড ড্রিঙ্ক আর চিপসের প্যাকেট নিয়ে খেলা দেখতে বসে বাকিরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন