Jadavpur University Student Death

শেষ অবধি রাজনীতির খেলা?

এখন ছাত্রের অকালমৃত্যুর পরে র‌্যাগিং নিয়ে জ়িরো টলারেন্সের কথা শোনা যাচ্ছে খুব। কিন্তু দশ বছর আগে এই মনোভাব ছিল কি?

Advertisement

সুজিষ্ণু মাহাতো

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২৩ ০৫:২৩
Share:

—প্রতীকী ছবি।

এমন কিছু নিয়মকানুন আছে, যা সব সময় মেনে নেওয়া যায় না। অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো থেকেই গেল।” বছর দশেক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ ছাড়ার ঘোষণা করার সময় এই উক্তি করেন শৌভিক ভট্টাচার্য। আইআইটি খড়্গপুর থেকে আসা শৌভিকের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। র‌্যাগিংয়ে অভিযুক্ত দুই পড়ুয়ার শাস্তি কমানোর দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্ররা তাঁকে ৫০ ঘণ্টা ঘেরাও করেন। শৌভিক মানেননি। র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে তাঁর এই কঠোর মনোভাব প্রশংসা কুড়িয়েছিল শিক্ষা মহলেও। তার পরেও পদত্যাগ করেন শৌভিক।

Advertisement

পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে সম্প্রতি মৃত প্রথম বর্ষের ছাত্রেরও। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ এবং মৃত্যু বহুমুখী তরজার জন্ম দিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বছর দশেক আগের শৌভিকের সেই ‘স্বপ্নভঙ্গ’-র অতীতকে ফিরে দেখা প্রয়োজন। বুঝতে সুবিধে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতি চলেছে দশকের পর দশক। ক্যাম্পাসের মধ্যে কাজ করা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থ তাকে জল-হাওয়া জুগিয়ে গিয়েছে। তাই সেই বাস্তুতন্ত্রের বদল না হলে বর্তমান ঘটনায় কারও যে শাস্তিই হোক না কেন, পরে যে আবার এমন হবে না, তা হলফ করে বলা কঠিন।

এখন ছাত্রের অকালমৃত্যুর পরে র‌্যাগিং নিয়ে জ়িরো টলারেন্সের কথা শোনা যাচ্ছে খুব। কিন্তু দশ বছর আগে এই মনোভাব ছিল কি? কেবল ছাত্ররা নন— অভিযোগ যে, আর্টস, সায়েন্স ও এঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিনেরাও নাকি র‌্যাগিংয়ে অভিযুক্তদের শাস্তি কমানোর দাবিতে সওয়াল করেছিলেন! শৌভিকের পদত্যাগের পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযুক্ত ছাত্রদের এক জনকে এক বছরের জন্য এবং আর এক জনকে ছ’মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছিল; কিন্তু ডিনেরা নাকি বড়জোর এক মাস শাস্তির পক্ষে সওয়াল করেন। এ নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে ডিনদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় বলেও প্রতিবেদনে দাবি।

Advertisement

র‌্যাগিংয়ের শাস্তি কমানোর দাবিতে আন্দোলনের পরে শাস্তি পুনর্বিবেচনার জন্য একটি প্যানেল তৈরি করেন উপাচার্য শৌভিক ভট্টাচার্য। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল-এর (ইসি) যে সদস্যরা এই শাস্তি পুনর্বিবেচনা করার পক্ষে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন উচ্চ শিক্ষা সংসদের তৎকালীন অস্থায়ী চেয়ারম্যান অভিজিৎ চক্রবর্তী। পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন, এবং তাঁর সময়কালেই ‘হোক কলরব’ আন্দোলন হয়। সেই প্যানেল রিপোর্ট জমা দেওয়ার আগেই শৌভিক পদত্যাগ করেন। ২০১৩-র অক্টোবরে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের উক্তি ছিল, “প্যানেল যদি র‌্যাগিংয়ের শাস্তি নিয়ে নরম অবস্থান নিত, তা হলে তা উপাচার্যের পক্ষে অপমানজনক হত।” অনুমান করা চলে যে, র‌্যাগিং নিয়ে তাঁর কড়া অবস্থান শৌভিকের উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগের একটা অন্যতম কারণ ছিল।

বছর দশেক আগে ওই শাস্তিই যাদবপুরে র‌্যাগিং নিয়ে কর্তৃপক্ষের ঘোষণা করা শেষ বড় শাস্তি। অথচ, তার সূত্র ধরে র‌্যাগিংকে নির্মূল করে দেওয়ার যাত্রা শুরু হতে পারত। তা হয়নি কোনও প্রাণ যায়নি বলে। এ বারের ঘটনাতেও প্রাণহানি না ঘটলে হইচই থিতিয়ে যেত। কেবল ২০১৩ নয়, ২০০৭ সালেও র‌্যাগিংয়ের সাজার প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছিল ক্যাম্পাসে। ছাত্রগোষ্ঠীর একাংশের বিরুদ্ধে অপরাধীদের আড়াল করার অভিযোগ তুলে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির ছাত্র সংসদের (ফেটসু) পদাধিকারীরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের ছাত্র প্রতিনিধিরা পদত্যাগ করেন। অর্থাৎ ১৬ বছর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্তৃপক্ষের কাছে ইঙ্গিত ছিল যে, র‌্যাগিং চলছে। তা বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছিল কি?

আসলে আর পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতোই, যাদবপুরেও ছাত্র রাজনীতির রাশ হাতে রাখা অনেকটা নির্ভর করে হস্টেল নিয়ন্ত্রণের উপরে। নানা আন্দোলনে হস্টেল-জনতা একটা বড় হাতিয়ার। আবার, ক্যাম্পাসে ছাত্রদের একাধিক আন্দোলনে শিক্ষককুলের একাংশই যে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যেতে পড়ুয়াদের উৎসাহ দিয়েছেন, কার্যত উস্কে দিয়েছেন, তেমন অভিযোগও নানা সময়ে সামনে এসেছে। অভিযোগ যে, সেই উস্কানির পিছনে দলীয় রাজনীতির কায়েমি স্বার্থও ছিল।

অথচ, এই সংগঠিত ছাত্রগোষ্ঠী যে অনেক ইতিবাচক কাজ করতে পারে তারও প্রমাণ রয়েছে। হিমেন্দু বিশ্বাস বহু বছর (১৯৫৮-৮৬) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন— প্রথমে ডিরেক্টর অব ইউথ ওয়েলফেয়ার, ও পরে ডিন অব স্টুডেন্টস হিসাবে। তাঁর ‘আমি ও আমার সময়’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় ছাত্রদের বন্যাত্রাণে সাহায্য করা-সহ নানা সামাজিক কাজে নামার পরিচয় পাওয়া যায়। ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক অমিত ভট্টাচার্যের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়: ইতিহাসে ও ব্যক্তিদর্পণে (১৯০৬-২০১৭) বইয়ে এ নিয়ে বিশদ বিবরণ রয়েছে। সম্প্রতি করোনার সময় ক্যাম্পাসে টানা গণ-রসুই চালানো, ঘূর্ণিঝড় আমপানের পরে ত্রাণকার্যে হস্টেলবাসী ও সাধারণ পড়ুয়াদের দেখা গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে, সাম্প্রতিক ছাত্রমৃত্যুর ভয়াবহ ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের এই গঠনমূলক ভূমিকার চেয়ে অন্ধকার দিকগুলিকেই সামনে নিয়ে আসছে বেশি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন