Rabindranath Tagore

কেমন করে গান করো...

পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তীর বানভাসি ঘটে গেলেও নানা ফেস্ট, সোশ্যাল, রিয়েলিটি শো, ফ্যাশন প্ল্যাটফর্মে নাচের সঙ্গে এই ধাঁচের গানের এখন বিপুল জনপ্রিয়তা।

Advertisement

অলক রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২৪ ০৮:২৯
Share:

—ফাইল চিত্র।

ভবানীপুর থানার সামনে গেলেই মনে আসে কান্তকবির গানের দু’টি চরণ, “কবে ভবের সুখদুখ চরণে দলিয়া, যাত্রা করিব গো শ্রীহরি বলিয়া...”। যে কোনও ঋতুতেই উল্টো দিকের, কলকাতার পুরনো ও বিখ্যাত জলযোগ-বিপণিটির কচুরি, ডাল, ল্যাংচার হাতছানি এড়ানোর উপায় নেই। শব্দের খেলা নিয়ে এ মজা অবশ্য সে-কালের তুমুল বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গায়ক মিন্টু দাশগুপ্তের মস্তিষ্কপ্রসূত। গায়ক আর তাঁর গানের মজা এ-কালে কোথায়? বরং বাংলা গানের দিকে তাকালে ভয় করে, বিশেষত সে গান যদি হয় রবীন্দ্রনাথের।

Advertisement

নায়িকার নাম হিয়া, তাই বাংলা সিরিয়ালে অবলীলায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে গান: ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’। মিউজ়িক ভিডিয়ো-শুরুর যুগে এক বার দেখা গেল, বন্ধ এক দরজার এ পাশে দাঁড়িয়ে গায়ক লিপ মেলাচ্ছেন তাঁরই গাওয়া ‘খোলো খোলো দ্বার, রাখিয়ো না আর’ গানটিতে। কোন দরজা যে খোলার কথা আছে গানে, ও-সব কে ভাবে! খুঁজতে কষ্ট করতে হবে না, ভূরি ভূরি মিলবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ন ও দৃশ্যায়নে এ-হেন বোকামো, স্থূলতা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতার উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন বিপাকে, বেকায়দায়— তাঁর গান ব্যবহারে যে আর কোনও মাসুল লাগে না!

নমুনা অনেক। রবীন্দ্রনাথের চণ্ডালিকা-য় জাতপাতের শিকার অন্ত্যজ রমণী তাঁর বেদনা ব্যক্ত করে। ইমনের আধারে সেই গান ‘ফুল বলে, ধন্য আমি’। সেখানে ‘দেবতা’ শব্দে রবীন্দ্রনাথ কোমল রেখাব স্পর্শ করেছিলেন নাটক ও কাব্যের খাতিরে। এ-কালের এক জন জনপ্রিয় গায়িকা ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী’ গাইতে গিয়ে হঠাৎ করে স্থায়ীর শেষে কোমল রেখাব আমদানি করলেন, সে কি একুশ শতকীয় ‘স্মার্টনেস’-এর খাতিরে? রবীন্দ্রনাথ এমন সুর দিয়েছেন কি না, যে সুরটা দিয়েছেন সেটা কেনই বা, সেটা মাথায় রাখার কিংবা গাওয়ার আগে একটু ভাববার প্রয়োজন থাকবে না গায়কের? সঙ্গীত পরিচালক কী চাইছেন, সেটাই হয়ে উঠবে অবিসংবাদিত শেষ কথা? সঙ্গীতমহলে মৃদু প্রতিবাদ হয়েছে, তাতে কী, সেই ‘স্বরচিত’ রবীন্দ্রসুর আর গান গাওয়া থামেনি। মুম্বইয়ের বাংলা জানা দক্ষিণী গাইয়ে নির্বিচার তান আলাপ-সহ ‘সজনী সজনী রাধিকা লো’ সপাটে গেয়েছেন ‘ভোকাল রিফ্রেন’ সমেত!

Advertisement

পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তীর বানভাসি ঘটে গেলেও নানা ফেস্ট, সোশ্যাল, রিয়েলিটি শো, ফ্যাশন প্ল্যাটফর্মে নাচের সঙ্গে এই ধাঁচের গানের এখন বিপুল জনপ্রিয়তা। আরও আছে। দক্ষ হাতে পিয়ানোবাদনের সঙ্গে, তৈরি-গলার রবীন্দ্রসঙ্গীতে যদি মুম্বই আর বাংলার পরিচিত গীতিকার, গায়ক, অভিনেত্রী, বাদকদের কিছু কিছু অবদান ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, ক্যামেরার কারিগরি যদি যুক্ত হয় সেখানে, আনা যায় সুকণ্ঠে রাগিণীর নির্যাস, তা হলে সেই উপাচারকে আর খিচুড়ি বলা যাবে না। বর‌ং সেই ভাঙা রবীন্দ্রগানের ‘ভিউয়ারশিপ’ দেখে মাথা ঘুরে যেতে বাধ্য। এই মহার্ঘ নবরত্ন পোলাওয়ের পাশে শুক্তোর আমেজ আনে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’-র স্বরলিপিমান্য মধুর গায়ন। সে-ও কিন্তু একটা বাংলা ছবিতেই, ১৯৫৩ সালের বউ ঠাকুরাণীর হাট। কিন্তু ও সব শোনার কান আর সময় হালের গাইয়েদের আছে কি?

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কবেই বলেছিলেন, বাংলাদেশ হলে এই ‘অনাচার’ দেখে হাসত না, উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা করত। এই বঙ্গে অবশ্য তেমন কিছু ঘটে না। “মম দুঃখ বেদন, মম ‘সফল’ স্বপন” যে রবীন্দ্রনাথ লেখেননি, লিখেছিলেন ‘সকল স্বপন’, এই মর্মে দেবব্রত বিশ্বাস-সহ বহু বিদগ্ধজনের বিস্তর তথ্যপ্রমাণ এবং লেখালিখিতে কর্ণপাত করেনি বিশ্বভারতী মিউজ়িক বোর্ড। আজও দিব্য বহাল ‘সফল’। প্রায় সব অনুষ্ঠানেই ‘রবিঠাকুরের গান গাইছি’ বলে গান ধরছেন গায়ক, এবং ধরছেন গানের মাঝখান থেকে— “ওরে রে ওরে মাঝি কোথায় মাঝি...” সে গানে স্থায়ী, অন্তরা, সুর সবই অব্যবস্থিত। কেন যে গোড়া থেকে ধরা যায় না গান, এই প্রশ্নের জবাব নেই এখনকার নামী গায়ককুলের অনেকের তরফেই।

অন্য ছবিও আছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সর্বদা বলতেন, ভাবের ভাষার অনুবাদ হয় না। তাই ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত ওঁর গলায় শুনিনি কদাপি। শেয়ার মার্কেটের ওঠাপড়ার সঙ্গে জীবন যুক্ত করে আহিরীটোলার দাউলাল কোঠারি রাতে বসতেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুবাদে। এক দিন মাঝরাতে ফোন করে প্রায় লটারি পাওয়ার আনন্দে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’ গানটার প্রথম লাইনের অনুবাদ ছ’মাসের চেষ্টায় করে ফেলেছেন তিনি। ‘কেমন করে’ গান গাওয়ার প্রকৃত অর্থ— এমন সুমধুর উপচার কোন প্রক্রিয়ায় গলায় সাজাচ্ছেন শিল্পী, তাই তো? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে গড়গড়িয়ে বলে গিয়েছিলেন দাউলাল, “তুম ক্যায়সে সুর মে গা রহ হ্যায় গুণী...”

এই দায়বদ্ধতার ছিটেফোঁটাও এই সময়ে মিলছে কি? ভয় হয়, কাজী নজরুল ইসলামের গানের মতো, সুরে তালে নিখুঁত রবীন্দ্রসঙ্গীতও এক দিন ‘আদি রবীন্দ্রসঙ্গীত’ তকমা পাবে না তো? রবীন্দ্রনাথের হাসির গানের সংখ্যা অতি অল্প, কিন্তু তাঁর গানের হাস্যকর পরিবেশন সংখ্যায় দিন দিন বাড়ছে। সেই বেনো জলে বাঁধ দেবে কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন