প্রকৃতির পাঠ থেকেই বিশ্ব-উষ্ণায়ন মোকাবিলা সম্ভব
Natural Disasters

পূর্বপ্রস্তুতির বিকল্প নেই

বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রভাব সবচেয়ে বেশি হয় দুই মেরু অঞ্চলে এবং হিমালয়, আল্পস-সহ সুউচ্চ পর্বতমালার মাথায় স্থায়ী হিমবাহগুলোতে সাক্ষী থাকে সমুদ্রতট।

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২৩ ০৪:৩৫
Share:

ভাঙন: ঘোড়ামারা দ্বীপ। ২০১৬ সালের ছবি। ফাইল ছবি।

চল্লিশ বছর আগে সমগ্র দক্ষিণ গুজরাতে উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভূমি ব্যবহার ব্যবস্থাপনায় ভূ-পরিবেশ সংক্রান্ত কাজে যুক্ত ছিলাম দু’বছর। তখন সেখানে মাত্র কয়েকটা শিল্প ছিল, পরে ছোট থেকে বড় অনেক শিল্প গড়ে উঠেছে। তিনটি ভিন্ন ‘প্রবৃত্তি’র ফাটল থাকায় সমগ্র উপকূল এলাকাটি ভূকম্পপ্রবণ। চ্যুতির মাত্রাও ছোট থেকে বড়। সৌরাষ্ট্রের দক্ষিণে সমুদ্রতলের অবনমন ধরা পড়েছে। মহাদেশীয় উপতট এই জায়গায় সবচেয়ে বিস্তৃত। অন্য জায়গায় উপতটের বিস্তার পনেরো থেকে তিরিশ কিলোমিটার। এই কর্দমাক্ত উপতটে জোয়ার-ভাটার খেলা চলে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাদামাখা তট যেন হামাগুড়ি দিয়ে ক্রমশ পূর্বে ভূমির দিকে এগিয়ে আসছে, যার থেকে সমুদ্রের জলস্তরের আপাত বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বছরে একশো মিটার মতো কাদামাটি এগোচ্ছে। সমুদ্রের প্রসার সমগ্র পশ্চিম তটেই লক্ষণীয়, তবে ভূপ্রকৃতি অনুসারে মাত্রা আলাদা।

Advertisement

একই ভাবে পূর্ব মহাদেশীয় উপতট এলাকায় বাংলা খাঁড়ির উত্তরে ফাটল আছে, সমুদ্রতলের অবনমন এবং সমুদ্রের জলস্তরের আপাত-বৃদ্ধি হচ্ছে। ডুবছে সাগরদ্বীপ, ঘোড়ামারা দ্বীপ-সহ একাধিক দ্বীপ এবং অন্য জায়গায় জেগে উঠছে বালির চর, তৈরি হচ্ছে নয়াচরের মতো নতুন দ্বীপ। হিমালয়ের হিমবাহ-উৎসারিত নদীগুলো থেকে পশ্চিমবঙ্গ আর আগের মতো জল পাচ্ছে না বলে উপতট এলাকায় নদীমুখে বালি জমে থাকছে। জলপ্রবাহ পূর্ব দিকে সরে যাওয়ায় বাংলাদেশের নদীগুলো বেশি পরিমাণে জল পাচ্ছে, উপতট এলাকাও অনেক ভাল।

বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রভাব সবচেয়ে বেশি হয় দুই মেরু অঞ্চলে এবং হিমালয়, আল্পস-সহ সুউচ্চ পর্বতমালার মাথায় স্থায়ী হিমবাহগুলোতে, সাক্ষী থাকে সমুদ্রতট। হিমবাহ যুগে মেরু অঞ্চলে বরফ জমায় সমুদ্রের জলস্তর নেমে গিয়ে তট উন্মুক্ত হয়। উষ্ণায়ন বরফ গলিয়ে সমুদ্রে জলস্তরের মাত্রা বৃদ্ধি করে। শেষ হিমবাহ যুগে উত্তর মেরুতে যে পরিমাণ বরফ জমেছিল, বর্তমান আন্তর্হিমবাহ কালে পৃথিবী ক্রমাগত গরম হয়ে তার অর্ধেক গলে গিয়ে সমুদ্রে জলের স্তর ১২০ মিটার বৃদ্ধি করেছে। উষ্ণায়নের শুরু থেকে মাত্র ছ’হাজার বছরে এই বৃদ্ধি। গত ছ’হাজার বছরে সমুদ্রে জলের মাত্রার সামান্য হেরফের হয়েছে। যে-হেতু উষ্ণায়ন চলছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাকৃতিক কারণেই বাড়ছে, তাই সমুদ্রের জলের মাত্রা বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জলের মাত্রা এক নাগাড়ে সমান হারে বাড়ে না, বরং কিছু সময় অতিরিক্ত বৃদ্ধি হয়— যেমন হয়েছিল সাত হাজার বছর আগে। সে সময় তাপমাত্রা আজকের থেকেও বেশি হয়ে গিয়েছিল। আবার ছোট ছোট বরফ যুগ এলে জলস্তর কিছুটা নেমে যাওয়ার ইঙ্গিতও মিলেছে।

Advertisement

উষ্ণায়নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমুদ্রের উপরিভাগে জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, যার কারণে বাড়তে পারে সামুদ্রিক ঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা। এ ছাড়াও বিষুবরেখার উপর সমুদ্রের জলের স্রোতের চরিত্র ঘন ঘন পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর সঙ্গে উল্লেখ করতে হবে বর্ষার সময় ও চরিত্রের পরিবর্তনের। এর ফলে সহস্রাধিক বছর ধরে অভ্যস্ত সময়ে কৃষিকাজ ব্যাহত হতে পারে— যে সময়ে যে জায়গায় যে ধরনের চাষ এখন উপযুক্ত, সেই জায়গা দেখা গেল বৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে রইল, অথবা সেখানে অল্প বৃষ্টিতে উপযুক্ত অন্য ফসলের চাষ করতে হল।

চার দশক আগে নওসারী জেলার ডান্ডি গ্রামে ক্যাম্প করেছিলাম। প্রথম দিনেই একটি মেয়ে ক্যাম্পে এসে আলাপ করল। সে নিউ জ়িল্যান্ডে চাকরিরত, ইঞ্জিনিয়ার। এসেছে তার পছন্দের সঙ্গীকে বিয়ে করে সেখানে নিয়ে যেতে। বিয়ে সে দিনই। জানলাম, দক্ষিণ গুজরাতে অনেক গ্রামেই মেয়েরা প্রবাসে স্বামীদের নিয়ে যায়। দু’দিন পর সে আমাকে তার গ্রাম দেখাতে নিয়ে গেল। গ্রাম-পঞ্চায়েতের সঙ্গে প্রবাসীরা মিলে যৌথ উদ্যোগে বাড়ি, বিদ্যুৎ, নলবাহিত জল, শৌচাগার ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছে, অনেকটা আজকের পিপিপি মডেলের মতো। সমুদ্রের নোনা জল প্রায়ই জলোচ্ছ্বাসে চাষের মাটি নষ্ট করে, তাই জমির মাটি লবণমুক্ত করার পদ্ধতিও সে বিদেশ থেকে শিখে এসে গ্রামের মানুষকে শিখিয়েছে। গ্রামের উন্নতির জন্য কাজ করে সে খুব খুশি। কেরলের কোট্টাকল গ্রামে আরব দেশগুলিতে কর্মসূত্রে থাকা ব্যবসায়ীরা গ্রামের উন্নতিতে প্রচুর ব্যয় করে দেখেছি। মুদির দোকানের মতো উন্মুক্ত সোনার দোকান দেখে অবাক হয়েছিলাম, চুরি হয় না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের আন্দামানে পুনর্বাসন এবং সরকারি সহায়তায় তাঁদের জীবনযাপন প্রথমে কষ্টকর হলেও পরে আর্থিক সচ্ছলতা আসে।

পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবনের বেশ কয়েকটা দ্বীপ ভাঙনের পথে। সেই দ্বীপবাসীদের পুনর্বাসন ছাড়া গত্যন্তর নেই। সামুদ্রিক ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যা প্রতি বছরের ঘটনা। জনজীবন বিপর্যস্ত। সরকারি উদ্যোগে বাঁধের বন্দোবস্ত হলেও দুর্যোগের সময় তা কাজে দেয় না। ফলে অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস। গত কয়েক বছরে মৌসুনি, সাগরদ্বীপ, নয়াচর ও ঘোড়ামারা দ্বীপে গিয়ে দেখলাম, জলোচ্ছ্বাস এবং লবণ প্রতিরোধকারী সুন্দরী গাছ যথেচ্ছ কাটা হয়েছে, যার ফলে দ্বীপগুলো সামুদ্রিক দুর্যোগের কাছে নগ্ন, অসহায়। খোলা সমুদ্র থেকে আসা বন্যার জলের স্রোত ধরে রাখার মতো ক্ষমতা বাঁধের নেই। পর্যটকের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে প্রথম অস্থায়ী বালিয়াড়ির উপর কংক্রিটের স্থাপত্য তৈরি করায় বালিয়াড়ি দুর্বল হয়ে ভিতরের বালিয়াড়ির ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তীরের মাটি-বালি ভেঙে জলে চলে যাচ্ছে। জলের মাঝে গড়ে উঠছে চর। বেশ কয়েকটা দ্বীপের বাসিন্দারা অন্যত্র চলে গেছে। ঘোড়ামারা দ্বীপের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নেই। বাকিদের মধ্যে পুরুষেরা অন্য রাজ্যে চাকরির খোঁজে আছে বা কাজ করছে। দ্বীপে বাস করা মহিলাদের অবস্থা শোচনীয়। চাষ প্রায় বন্ধ, মিঠে পানের চাষও নোনা জলে নষ্ট হচ্ছে। মাছের চাষের ভেড়িতে নোনা জল ঢুকে গেছে। আর্থিক অবস্থা করুণ।

বাড়ির মহিলাদের কিছু অন্য ধরনের কাজের ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত এবং একটি অসরকারি কল্যাণমূলক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমন স্বনির্ভর প্রকল্প সাগরদ্বীপেও করা হয়েছে, তাদের উৎপাদন সামগ্রীর চাহিদাও বাড়ছে। আরও কিছু সংস্থার উদ্যোগে নতুন নতুন প্রকল্প চলছে। গ্রাম বা দ্বীপ বাধ্য হয়ে ছাড়তে হলেও, সেলাই মেশিন বা এ ধরনের জিনিস নিয়ে গিয়ে অন্যত্র কাজ শুরু করা সুবিধার। কয়েকটি দ্বীপ থেকে এক সময় রমরমিয়ে চলা সরকারি মৎস্য প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় লোকেরা সেই ভেড়িতেই মাছ চাষ করছেন। প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যাও কম।

জলবায়ু পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। মূলত উত্তর ভারতে সিন্ধু-গাঙ্গেয় উপত্যকায়, সাত হাজার বছর আগে থেকে পরবর্তী তিন হাজার বছর ধরে বৃষ্টির স্থান-কাল-চরিত্র মাঝেমধ্যে বদলে গিয়েছে। ফলে তখনকার কৃষিভিত্তিক সভ্যতা বার বার স্থানান্তরিত হয়েছে। এর কোনও লিখিত ইতিহাস নেই, মাটি পাথর প্রত্নসামগ্রী পাঠ করে সে শিক্ষা পাওয়া যায়। নদী ও উপতট প্লাবিত হলে সেখানে অধিবাসীদের পুনর্বাসন ও উপার্জনের ব্যবস্থা করা, বর্ষার সময় ও চরিত্র পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষিব্যবস্থাকে যুক্ত করা, তাপ প্রতিরোধক বাসস্থান ইত্যাদি বিষয়ে আগে থেকেই যৌথ উদ্যোগে পরিকল্পনা নেওয়ার সময় এসেছে। জীববৈচিত্রকে যথাসম্ভব বজায় রাখতে হবে। অযথা আতঙ্কিত না হয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ঠিকমতো কাজে লাগিয়ে প্রস্তুত থাকা জরুরি, যাতে অতর্কিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বেসামাল হতে না হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন