শান্তিপূর্ণ ভোটের দায় যেমন শাসকের, তেমন বিরোধীদেরও
Panchayat elections

শুভবুদ্ধি জাগবে কি

এটা অনেকাংশে সত্যি যে, প্রত্যন্ত গ্রামের একেবারে নিচুতলায় এলাকার জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সময় সর্বদা উপরতলার রাজনীতি সমান তালে কাজ করে না।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২২ ০৬:১১
Share:

পঞ্চায়েত স্তর থেকে রাজনৈতিক দখলদারি কায়েম করলে অর্থ এবং দাপট দুয়েরই সুযোগ বাড়ে। নিজস্ব চিত্র।

পঞ্চায়েত ভোটের বাদ্যি বেজে উঠেছে। বৃহত্তর রাজনীতিতে পঞ্চায়েতের ভোট কতটা প্রভাব ফেলে, এই ভোটের দ্বারা লোকসভা বা বিধানসভার জনমত কতটা নিয়ন্ত্রিত হয়, তা নিয়ে বহু মত ও তত্ত্বের চর্চা হয়ে থাকে।

Advertisement

এটা অনেকাংশে সত্যি যে, প্রত্যন্ত গ্রামের একেবারে নিচুতলায় এলাকার জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সময় সর্বদা উপরতলার রাজনীতি সমান তালে কাজ করে না। সেখানে গ্রাম পঞ্চায়েতের সাধারণ ভোটারেরা অনেক ক্ষেত্রে মোদী-মমতা, অভিষেক-শুভেন্দু ভাবার আগে তাঁদের ব্যক্তিগত বা স্থানীয় আরও বিভিন্ন বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেন।

তার ফলে ‘জোট’ও দেখা যায় নানা রকম। তাই গ্রাম পঞ্চায়েতে কোনও ‘বি-ষম’ চিত্র দেখলেই তাকে এক কথায় বড় রাজনীতির প্রতিফলন ভেবে নেওয়া সব সময় সঠিক না-ও হতে পারে। এটি পঞ্চায়েত নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র।

Advertisement

তবে এ কথা অনস্বীকার্য, পঞ্চায়েত স্তর থেকে রাজনৈতিক দখলদারি কায়েম করলে অর্থ এবং দাপট দুয়েরই সুযোগ বাড়ে। ক্রমশ বড় হয় সুবিধাভোগীদের বৃত্ত। তার মানে, সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। এ সবই দলনির্বিশেষে শাসকের পক্ষে একটি অ্যাডভান্টেজ এবং একটি পরীক্ষিত সত্য। আর এটাও সবাই জানেন, ক্ষমতার উত্থান-পতন মূলত নির্ধারিত হয় গ্রামের ভোটে। কারণ, ভোটার সংখ্যায় গ্রামাঞ্চল অনেক এগিয়ে।

তাই পঞ্চায়েতকে ক্ষমতার প্রথম সোপান ধরে নিয়ে এখান থেকেই রাজনৈতিক সংঘাতেরও সূত্রপাত হয়। ফলে উঁচুতলার উত্তাপ বাড়তে থাকলে নীচেও তার আঁচ বাড়ে। বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূল—যত দিন যাচ্ছে, পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে দ্বন্দ্ব ও তাপ ততই বাড়ছে। তীব্র হচ্ছে হিংসা, হানাহানি।

সিপিএমের আমলে তারাও ছলে-বলে-কৌশলে পঞ্চায়েত দখল করে গিয়েছে। তৃণমূলের ‘গর্ব’ অনুব্রত মণ্ডলের মতো চড়াম চড়াম ঢাক বাজিয়ে গুড়-বাতাসা খাওয়ানোর ঘোষণা সিপিএম করত না। তবে গ্রামবাংলায় ঘুরলে তখন ‘নীরব সন্ত্রাস’ ছিল খুব চেনা শব্দ। হুগলি, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, কোথায় নয়!

বিরোধী কংগ্রেস তখন কী ভাবে গুটিয়ে-সিঁটিয়ে থাকত, সেটাও পুরনো কংগ্রেস নেতাদের ভোলার কথা নয়। মারামারি খুনোখুনি তো ছিলই। তা ছাড়াও হাটে-বাজারে ভয় দেখিয়ে, কখনও সামাজিক বয়কটের শাসানি দিয়ে, স্বামী ভোটে দাঁড়ালে স্ত্রী-র কাছে বিধবার থান পৌঁছে দিয়ে, সর্বোপরি বুথে ঢুকে ব্যালট ছিনিয়ে একতরফা ছাপ মেরে পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএম একাধিপত্য নিশ্চিত করে এসেছে কয়েক দশক। কোনও ‘ঝুঁকি’ নেয়নি।

তাই দেখা যেত, একটি বুথে সিপিএম হয়তো পেয়েছে ন’শো ভোট, বিরোধী কংগ্রেস দশ-বিশ-পঞ্চাশ! জেলার পর জেলায় এমন উদাহরণ ছিল মুড়ি-মুড়কির মতো। নেতারা বলতেন, জনগণ ভোট না দিলে কী করতে পারি! বড়ই ‘নির্মম’ ছিল সেই ‘সত্য’!

নিজেদের জয়ের সম্ভাবনা সত্ত্বেও বিরোধীদের যে কোনও ভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বিবিধ প্রকরণ ও তা কাজে লাগানোর চেষ্টা আসলে শাসকদের ‘ধর্ম’। সেখানে সিপিএম, তৃণমূল বা বিজেপির মধ্যে তফাত করা কঠিন। সোজা কথায়, এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাসীনের ‘গণতন্ত্র’।

তৃণমূলের রাজত্বে গত পঞ্চায়েত ভোটের অভিজ্ঞতাতেও সেটা স্পষ্ট। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিস্তর আসনে শাসকের জয় যার অন্যতম। পাশের রাজ্য ত্রিপুরায় আবার ক্ষমতাসীন বিজেপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নিয়েছে নব্বই শতাংশেরও বেশি আসন। কে কার অলঙ্কার!

বামেরা ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় বসলেও পঞ্চায়েত ভোটে বড় সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠা শুরু হয় মোটামুটি ১৯৮৮ অর্থাৎ তৃতীয় দফার ভোট থেকে। একই ভাবে বামেদের পতন ঘটিয়ে ২০১১-তে তৃণমূল সরকারে আসার পরে ২০১৩-র প্রথম পঞ্চায়েত ভোট খুব ঘটনাবহুল ছিল না। কারণ, মূল বিরোধী বামেরা তখন একেবারেই কোণঠাসা।

রাজ্যে বিজেপি কিছুটা মাথাচাড়া দেওয়ার পরে ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন উত্তেজনার শিখরে পৌঁছয়। জুলুমবাজি শুরু হয় মনোনয়ন পর্ব থেকেই। পুলিশের হিসাবে শুধু ভোটের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ৬। আর অন্যান্য হিসাবে সংখ্যাটি প্রায় তিনগুণ।

শাসক তৃণমূল বলেছিল, নিহতদের বেশির ভাগ তাদের লোক। তবে তর্কের ঊর্ধ্বে যেটা বাস্তব, তা হল, ওই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ছিল না। অনেকের ধারণা, গ্রামবাংলায় সে বারের রক্তক্ষয়ী পঞ্চায়েত ভোট ২০১৯-এর লোকসভায় রাজ্যে বিজেপির ১৮ আসন জেতার পিছনে একটি কারণ।

আবারও সময়ের হিসাবমতো লোকসভা ভোটের আগে পঞ্চায়েত। এ বারের এই ভোটের আবহ নানা দিক থেকে অনেকটা আলাদা। তাৎপর্যপূর্ণও বটে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকে দেখলে বোঝা যায়, ইদানীং যে কোনও ভোটের আগেই কেন্দ্রীয় তদন্তের তৎপরতা বেড়ে যায়। এর মধ্যে অবশ্যই কেউ রাজনীতির উপাদান খুঁজে পেতে পারবেন। যেমন পাচ্ছে তৃণমূল।

কিন্তু গত কয়েক মাসে সিবিআই এবং ইডি-র অভিযানে রাজ্যের মন্ত্রী, নেতা থেকে ক্ষমতাশালীদের অনেকে বিপুল অঙ্কের আর্থিক দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে যে ভাবে জেলে ঢুকেছেন, তেমনটি বাংলায় আগে কখনও হয়নি। দুর্নীতির কোন শিকড় কতটা গভীরে, তা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে যা হয়েছে, তাতে সামগ্রিক ভাবে শাসকদের উপর চাপ যে বেড়েছে, সন্দেহ নেই।

লোকচক্ষে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সুস্থ ও স্বচ্ছ প্রমাণ করা তাই এ বার তৃণমূলের খুব বড় রাজনৈতিক দায়। ধাক্কা-খাওয়া ভাবমূর্তি মেরামত এবং গ্রহণযোগ্যতার ভিত শক্ত করার এটিই হবে জনতার দরবারে তাদের হাল আমলের প্রথম বড় পরীক্ষা।

শাসক দলের নবীন কান্ডারি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, পঞ্চায়েত ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে তাঁরা কৃতসঙ্কল্প। তাঁর ওই ঘোষণার মধ্যে দৃঢ়তা রয়েছে। তবে সেই সদিচ্ছা রাজনৈতিক স্তরে কী ভাবে কত দূর কার্যকর করা যায়, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।

যেমন, বহু লোকের ধারণা, বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডল জেলে থাকায় এ বার জুলুমের আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠা জেলাটিতে অভিযোগ হয়তো কমে যাবে। রাস্তায় ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়ে না থাকলে বা ভোটের দিন ‘নকুলদানা’ বিলোনোর বহর কমে গেলে পরিস্থিতিও হয়তো কিছুটা ‘শান্তি’ খুঁজে পাবে! তৃণমূলের অন্দরমহল থেকেও শোনা যাচ্ছে, অভিষেক এ বার এ সব নিয়ে খুবই ‘সতর্ক’।

কিন্তু শাসক দলের কোনও বিধায়ক যদি নিজের দলে অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিধান দেন, কোনও সাংসদ টিভির পর্দায় বোমা বাঁধার ফর্মুলা শেখান, আরও নিচুতলার কেউ বিরোধীদের স্ট্রেচারে চাপিয়ে ফেরত পাঠানোর শাসানি শোনান, তা হলে!

একই ভাবে আজকের বিজেপির অন্যতম ‘মুখ’ হয়ে ওঠা বিধায়ক মহিলাদের হাতে ত্রিশূল তুলে দিয়ে বলছেন, “বাকিটা ওঁরা নিজেরাই বুঝে নেবেন।” তাঁরই দলের সাংসদ আর এক কেন্দ্রীয় পদাধিকারী ‘বুকে পা তুলে দেব’ বলে কর্মী-সমর্থকদের হাততালি কুড়োচ্ছেন! এ সবের পরিণাম কী হতে পারে, তাঁরাও ভেবে দেখেন?

কথাগুলি তুচ্ছ মনে হলেও শুভবুদ্ধির কাছে আশঙ্কার মেঘ। কারণ, আগুনের একটি ফুলকি থেকেই দাবানল হয়ে যায়। বিশেষ করে ভোটের আবহাওয়ায়। তারও প্রমাণ অনেক।

ঘটনাচক্রে বিধানসভা ভোটের পরে বিজেপির তোলা সন্ত্রাসের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিশনের সদস্য হয়ে এসেছিলেন যিনি, তিনি এখন বাংলার নবাগত রাজ্যপাল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে পাঠানো রিপোর্টে তাঁরা সে দিন বর্তমান সরকার ও শাসক দলকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। এ বার তিনি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। থাকবেন লোকসভা ভোটের সময়ও।

সে যা-ই হোক, এটা অবশ্যই বলার, কোনও নির্বাচন সত্যিই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে হলে শাসক এবং বিরোধী উভয়েরই সদর্থক ভূমিকা আবশ্যক। শুধু আসন জেতাই শেষ কথা হতে পারে না। এটা না বুঝলে শান্তির ললিত বাণী ব্যর্থ পরিহাস হতে বাধ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন