গায়ের জোরে চাপানোর চেষ্টা হলে সেই উৎসব বাঙালি মানে না
Dhanteras

ধনতেরসে সোনা কেন

পৌরাণিক কাহিনিতে উপদেশ অনুযায়ী  ধনতেরসের নিয়ম মেনে পুজো করলে আর দীপ দান করলে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা যায়।

Advertisement

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২২ ০৬:৩৫
Share:

ধনলক্ষ্মী: ধনতেরসের দিন গয়নার দোকানে ক্রেতার ভিড়।

বাঙালি যে সব ব্যাপারেই আলাদা, প্রতি পদে তা বোঝা যায়। অষ্টম শতাব্দীতে যখন সারা ভারতবর্ষ বৌদ্ধ ধৰ্মকে পরিত্যাগ করে আদি শঙ্করাচার্যের ডাকে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের জয়জয়কার করছে, ঠিক তখনই পাল রাজাদের মতো এক বৌদ্ধ বংশকে বাংলা সিংহাসনে বসাল তিনশো বছরের জন্যে। আবার ত্রয়োদশ শতাব্দী যখন দিল্লির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুলতানদের কুর্নিশ করতে ব্যস্ত, বাংলায় শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এক পৃথক স্বাধীন বঙ্গরাজ্য ঘোষণা করে ‘টা টা’ বলে বেরিয়ে এলেন। বর্তমানে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্বের কথা তো বাদই দিলাম।

Advertisement

বাঙালি পিতৃপক্ষ পালন করে মহালয়ার দিন, অথচ ভারতের অন্যান্য জায়গায় পিতৃপক্ষ পালিত হয় দেওয়ালির সময়। বাঙালি দেওয়ালির সময় ধুমধাম করে লক্ষ্মীর আরাধনা না করে দুর্গাপুজোর সাত দিন পর খুব শান্ত ভাবে প্রায় গোপনে লক্ষ্মীপুজো করে। এমনকি বাঙালি কারিগররা তাঁদের যন্ত্রপাতির পুজো সেরে ফেলেন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বিশ্বকর্মা পুজোর দিন, অথচ বাকি ভারত হয় দুর্গাপুজোর দশমী কিংবা দেওয়ালির সময় যন্ত্রের পুজো করে। দেওয়ালির সময় অন্যরা যখন সহস্র আলো জ্বালিয়ে গৌরবর্ণা দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করে শ্রী-সম্পদ চায়, তখন বাঙালি অমাবস্যার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা দেবীর পুজো করে শক্তি চায়। শক্তি অবশ্য তার খুবই দরকার। দেওয়ালিতে অন্য ভারতীয়রা সম্পূর্ণ নিরামিষ খায়, আর মাংস এবং রক্তবর্ণ জবাফুল ছাড়া বাঙালির কালীপুজো হয় না। এবং, অধিকাংশ ভারতীয়ের কাছে দেওয়ালির পিছনে আছে কৃষ্ণের নরকাসুর বধের কাহিনি, বাঙালির কালীপুজো এসেছে স্কন্দপুরাণে দেবী চণ্ডীর রক্তবীজ নিধনের সূত্র ধরে। রক্তবীজের প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে অসুরের জন্ম হয়ে চলেছিল, শেষে চণ্ডী ভয়ঙ্করী কালীমূর্তি ধরে সমস্ত রক্ত পান করে নিলে দানবকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছিল। বাঙালির কালীপুজো একটা রাতের ব্যাপার, কিন্তু ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে দেওয়ালির উৎসব হয় চার-পাঁচ দিন ধরে— শুরু হয় ধনতেরস দিয়ে, তার পর চলে ছোটি দেওয়ালি, বড়ি দেওয়ালি, গোবর্ধন পুজো আর শেষ হয় ভাই দুজ বা ভাইফোঁটায়।

দেওয়ালির শেষ অনুষ্ঠান ভাইফোঁটাকে যেমন বাঙালিরা গ্রহণ করে নিজেদের মতো সাজিয়ে নিয়েছে, বছর কয়েক ধরে দেখা যাচ্ছে যে, দেওয়ালির দু’দিন আগের পর্ব ধনতেরস-ও এখন এক শ্রেণির বাঙালির কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ধনতেরস কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর তিথিতে পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠান অকুণ্ঠচিত্ত ভাবে ধন ও ঐশ্বর্যের জন্যে, তাই ধনতেরস বলা হয়। সে দিন নতুন বাসন, অলঙ্কার ইত্যাদি কেনার একটা বাধ্যবাধকতা আছে।

Advertisement

পুরাণ বলে, শ্রী প্রতিষ্ঠার জন্য যে সমুদ্র মন্থন হয়, তাঁর ফলে ১৪টি বিশেষ রত্ন পাওয়া যায়। তার চতুর্দশ ছিল অমৃত কলস, যা নিয়ে আসেন ধন্বন্তরী। তার দু’দিন পরে স্বয়ং মা লক্ষ্মী দেখা দেন। তাই ধনতেরসের দু’দিন পর দীপাবলিতে প্রধানত লক্ষ্মীর পুজো হয়। আর একটি গল্প বলে যে, বামনরূপী বিষ্ণু তাঁর তৃতীয় পা রাজা বলির মস্তকে রাখেন আর পাতালে পাঠিয়ে দেন, ফলে দেবতারা বলির ভয় থেকে মুক্তি পান, আর একেই ধনতেরস উৎসব হিসেবে পালন করা হয়।

পৌরাণিক কাহিনিতে উপদেশ অনুযায়ী ধনতেরসের নিয়ম মেনে পুজো করলে আর দীপ দান করলে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা যায়। এই গল্পটি আবার অনেকখানি আমাদের মনসা মঙ্গলের মতো। হিম রাজার সন্তানের কপালে একটি অভিশাপ ছিল। সে নাকি বিয়ের চতুর্থ রাতে ঘুমিয়ে পড়লেই মারা যাবে। আর এই রাতটা ছিল ধনতেরসের তিথিতে। পতিব্রতা স্ত্রী তাদের ঘরের বাইরে তার যত অলঙ্কার ছিল, সব এক ঢিপি করে রাখল। গভীর রাতে যখন যমরাজ সাপের রূপ ধারণ করে এলেন, তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওই গয়নার স্তূপ আর জ্বলজ্বল করা মণিরত্ন দেখে। তিনি আর কক্ষে প্রবেশ করলেন না। হিমরাজার পুত্র সারা রাত বধূর সহস্র গল্প শুনে কাটালেন, আর ভোরে যমরাজ একাই ফিরে গেলেন। তাই এই ধনতেরসের রাতে যত সোনা আর ধনরত্ন জোগাড় করা যায়, ততই মঙ্গল আর শুভ।

আসল সত্যটি হল যে, হিন্দু ধর্ম ধন অর্জন করাকে একটি বড় গুণ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, আর চায় যে, এর একটি অংশ ব্রাহ্মণ, মন্দির ও পূজার্চনায় খরচ হোক। এই উৎসবের সময় ব্রাহ্মণ, রাজা, জমিদারকে শস্য ও বিভিন্ন উপহার দেওয়ার রীতি ছিল। ধর্মীয় আচারে এই রীতির উপরে জোর দেওয়া হয়েছে— এই কারণে, যাতে ব্যবসায়ী, কৃষক এবং সাধারণ গৃহস্থরা ঈশ্বর ও শাসককে তাঁদের প্রাপ্য দিতে না ভোলেন। অনেক অঞ্চলে ব্যবসায়ীরা হালখাতা শুরু করেন এই পুণ্য লগ্নে। দেওয়ালি এবং ধনতেরসে গয়না আর বাসনপত্র কেনার যুক্তি হল, ব্যবসায়ী ও কারিগররা যাতে নতুন ফসল থেকে প্রাপ্য আয়ের একটা অংশ পান। সেই জন্যই এই উপহার ও কেনাকাটার রীতি।

এমনকি এই সময় জুয়া খেলারও অনুমতি মেলে। যে ধর্ম লক্ষ্মী, কুবের ও গণেশের ছবি বা চিত্রের সামনে ‘শুভ লাভ’ লিখে মুনাফা পুজো করে, সেখানে অবাক হওয়ার কোনও কারণ নেই। তাই অক্ষয় তৃতীয়া আর ধন ত্রয়োদশীর মতো অনুষ্ঠানে ক্রয় ও দান বিধি করা আছে বা ছিল। তাতে সমাজের মধ্যে ধনের সঞ্চালন হয়, যা সকলের পক্ষেই লাভজনক। চাহিদা, উৎপাদন, বিক্রয় ও সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে সম্পূর্ণ অর্থনীতির উপকার হয়।

আশ্বিন-কার্তিক মাসে ফসল কাটার সময় লক্ষ্মীপুজো করার একটা যুক্তি রয়েছে। সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেছেন, “লক্ষ্মীর অপর একটি নাম শ্রী। শ্রী নামটি এসেছে ল্যাটিন ‘সেরেস’ থেকে, যার অর্থ হল শস্যের অধিষ্ঠাত্রী।” সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘শ্রী’র সমতুল্য ইন্দো-চিন ও ইন্দোনেশিয়ার দেবী ‘দেবী সিরি’র কথা লিখেছেন। সুকুমারী ভট্টাচার্য আরও বলেছেন যে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় এই শস্যের দেবীর উপাসনা করা হয়— দেবীমূর্তির হাতে একগুচ্ছ শস্যের শিষ অথবা গ্রিক ‘কর্ন্যুকোপিয়া’ বা শস্যপাত্র। বাঙালি কিন্তু দেওয়ালির সময় ধুমধাম করে লক্ষ্মীর আরাধনা করে না।

ধনতেরসের প্রথায় হিন্দিভাষী ও সংলগ্ন সভ্যতার ছাপ অনেক বেশি। হিন্দি সিনেমার প্রভাবে বাঙালি বিয়ের আগের দিন এখন আমরাও নাচ গানের ‘সঙ্গীত’ নামক অনুষ্ঠান অবলম্বন করছি। এখানে এখন কিছু বিবাহিত মহিলা করওয়া চৌথের ব্রত পালন করা শুরু করেছেন। বিশ্বায়নের যুগে অনেকেই উঠে পড়ে লেগেছেন ঐশ্বর্যের পুজোয়। আগে যাঁরা বিপ্লব-টিপ্লব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতেন, তাঁদের ও-সবের জন্যে আর সময় নেই। অতএব ধনতেরসে নিয়ম মেনে একটু সম্পদ বাড়ালেও বা ক্ষতি কী? কোজাগরী পূর্ণিমার পুজোয় মা লক্ষ্মী বাংলায় খুব একটা ধনদৌলত যখন দিলেন না, তখন এই পথে চলে দেখাই যাক না।

আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন অনেক সময়ই সটাং সটাং হিন্দিতে কথা বলছে। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা সব ব্যাপারে হিন্দিভাষীদের নকল করছি। বিয়েতে ‘সঙ্গীত’-এর চলের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। বেশ কয়েক বছর আগে একটি সিনেমার প্রভাবে বাঙালিরা হঠাৎ সন্তোষী মা’র পুজো শুরু করেছিল। তাতে অবশ্য আমরা আমাদের সংস্কৃতি ছাড়িনি। দেওয়ালির আগের রাতে ওরা পালন করে নরক চতুর্দশী আর আমাদের হল ভূত চতুর্দশী। দু’টির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। বাঙালিদের মতো কেউ এত যত্ন করে চোদ্দো শাক জোগাড় করে বলে আমার জানা নেই। আর দেওয়ালির পরের দিন গোবর্ধন পুজো করে ওরা কী কষ্টই না করে কৃষ্ণকে ছাপান্ন ভোগ তৈরি করে দিতে।

কিন্তু গায়ের জোরে আর ত্রিশূল তরোয়াল দেখিয়ে যেই রামনবমী বা হনুমান পুজো করার চেষ্টা হল, বাঙালি তা মানতে চাইল না। কারণ— জবরদস্তি নেহি চলেগা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন