যা ছিল, যা হয়েছে
Dehradun

সেই পাহাড়ি আভিজাত্য, ঐতিহ্যের সুগন্ধ আজ ছায়াময় অতীত

এখনও দেহরাদূনের সহস্রধারা রোডে আছে কালুগা স্তম্ভ। যুদ্ধে নেপালি গোর্খাদের বীরত্বে মুগ্ধ ইংরেজরা এই স্তম্ভ গড়ে দিয়েছিলেন।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২১ ০৬:১১
Share:

উইকএন্ডে নীচে নামবেন না। সাঙ্ঘাতিক পাগলপারা ভিড়, সতর্ক করেছিলেন ল্যান্ডরের তিন পুরুষের বাসিন্দা সুনীল প্রকাশ। নীচে মানে মসূরী শহরে। সেখানে দিল্লি থেকে গাড়ি নিয়ে সবাই উইকএন্ড ‘মানাতে’ আসে, করোনা-পরিস্থিতিতে ভিড় বেড়ে গেলে পুলিশ ব্যারিকেড গড়ে মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি নীচে রাজধানী দেহরাদূনেও পাঠিয়ে দেয়। উত্তরাখণ্ডের এই শৈলশহরে তখন তাদের প্রবেশ নিষেধ।

Advertisement

সন্ধ্যাবেলায় দেহরাদূন, মসূরী ছাড়িয়ে গাড়ি ল্যান্ডর বাজারের অপ্রশস্ত, সরু রাস্তায়। উঠতে উঠতে চোখে পড়ে পাশেই তিব্বতি রেস্তরাঁ— দোমা। লোহার দরজা খোলা, ভিতরে দেখা যাচ্ছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। ওখানেই থাকেন আওয়ার ট্রিজ় স্টিল গ্রো ইন দেহরা বা আ ফ্লাইট অব পিজিয়নস-এর লেখক রাস্কিন বন্ড। এ বারেই আমাদের শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাহিত্য অকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন রাস্কিন, কিন্তু সাতাশি বছরের লেখককে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছা করেনি। একদা সপ্তাহান্তে মসূরীর ‘কেমব্রিজ বুক ডিপো’ নামে এক বই-দোকানে বিকেলে বসতেন, নিজের বইয়ে সই দিতেন। মা-বাবার সঙ্গে অনেক শিশু এই দোতলাতেও উঠে আসত। একদা দেহরাদূন থেকে ফিরছেন, এক বালকের হাতে তাঁর বই। জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার বই? বালকের উত্তর, আমার। রাস্কিন বন্ডের পাল্টা জবাব, “নো, ইট ইজ় মাইন।” এই করোনাকালে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো রাস্কিনও ঘরবন্দি। শুনলাম, কেমব্রিজ বুক ডিপো তাঁর কাছে ফি-সপ্তাহে বালক-বালিকাদের নাম-সহ বই পাঠিয়ে দেয়, রাস্কিন দোতলায় বসে তাতে সই করে ফের নীচে পাঠিয়ে দেন।

চড়াই বেয়ে গাড়ি এগোলে ঘিঞ্জি বসতি, উড়ছে তিব্বতি প্রেয়ার ফ্ল্যাগ। এটাই ১৮২৫ সালে ফ্রেডরিক ইয়ং-এর তৈরি ল্যান্ডর-মসূরী অঞ্চলের প্রথম পাকা বাড়ি— ‘মুলিঙ্গার’। ফ্রেডরিকের সৌজন্যেই এ বাড়ির হাতায় দূন উপত্যকায় প্রথম আলু চাষ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য ফ্রেডরিক অন্য রকম মানুষ ছিলেন। চোদ্দো বছর বয়সে ভারতে আসা। কোম্পানির হয়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় ওলন্দাজ সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সবচেয়ে উল্লেখ্য যুদ্ধটা দূন উপত্যকায়, নেপালিদের বিরুদ্ধে। হরিদ্বার, হৃষীকেশ, দেহরাদূন, সবই তখন নেপাল ও স্থানীয় রাজাদের অধিকারে। ফ্রেডরিক ও তাঁর উপরওয়ালা ডেভিড অক্টারলনি নেপালের বিরুদ্ধে টানা কয়েক বছর যুদ্ধ চালালেন। শেষে ১৮১৬ সালে সাগাউলির সন্ধি। কোম্পানির অধীনে এল দূন উপত্যকা।

Advertisement

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কি শুধু যুদ্ধই করে? এখনও দেহরাদূনের সহস্রধারা রোডে আছে কালুগা স্তম্ভ। যুদ্ধে নেপালি গোর্খাদের বীরত্বে মুগ্ধ ইংরেজরা এই স্তম্ভ গড়ে দিয়েছিলেন। পরাজিত শত্রুর উদ্দেশে দুনিয়ায় ব্রিটিশ সেনার একমাত্র শ্রদ্ধার্ঘ্য। সাহারানপুরের জেলে তখন গোর্খা যুদ্ধবন্দিরা, অক্টারলনি জিজ্ঞাসা করলেন, এঁদের নিয়ে কী করা যায়! ফ্রেডরিক বললেন, “স্যর, আমাকে দায়িত্ব দিন, আমি এঁদের সবাইকে ছেড়ে দেব। তার পর তাদের কোম্পানির হয়ে যুদ্ধের প্রস্তাব দেব।” অক্টারলনি রাজি। ফ্রেডরিকের বুদ্ধিতে তৈরি বাহিনীই গোর্খা রেজিমেন্টের পূর্বসূরি। গত কয়েক দশক ধরে ইতিহাস বদলের হিড়িক। হিন্দুত্ববাদীরাই প্রথম নন, আমার শহরে ঢের আগে অক্টারলনি মনুমেন্টের মাথায় লাল রং করে শহিদ মিনার নাম দেওয়া হয়েছে। কিসের শহিদ কেউ জানে না।

এই মুলিঙ্গার যে কত বদল হল! কখনও ব্রিটিশ সেনার ছেলেপুলেদের জন্য স্কুল, কখনও হোটেল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মায়ানমার, আন্দামান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরাস্ত ব্রিটিশ সেনা সপরিবারে আসতে থাকে সেখানে। সকলের অস্থায়ী ঠিকানা মুলিঙ্গার হাউস। ১৯৪৭-এ দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক হানাহানি। পাকিস্তানগামী মুসলমানদের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল রডরিক মিনচিন বাড়িটা ছেড়ে দিলেন। ১৯৫৯-এ জওহরলাল নেহরু এটিকে ছেড়ে দেন দলাই লামার সঙ্গে আসা তিব্বতি শরণার্থীদের জন্য। এখনও তিব্বতিদের মুলিঙ্গার বাজারে সোয়েটার থেকে মাছ-মাংস সব পাওয়া যায়। ভারতীয় সেনার গৌরবজনক ইতিহাস এখানে মনে পড়ে যাবে, যে সেনা হিন্দু, মুসলমান, শিখ, পাঠানের মিশ্রণে তৈরি।

এই যে তালিবান, আফগানিস্তান নিয়ে চিৎকার, ব্রিটিশরা এক বারই ভারতীয় সেনাদের নিয়ে কাবুলকে হারাতে সমর্থ হয়: ১৮৩৯-এর ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে। আফগানিস্তানের শাসক দোস্ত মহম্মদকে মসূরীতে নির্বাসন দেওয়া হয়। মসূরীর যে জায়গাটায় বন্দি ছিলেন তিনি, সেটাই আজকের অ্যালেন মেমোরিয়াল স্কুল। সে বার শেষরক্ষা হয়নি। ব্রিটিশের পুতুল শাসককে নিয়ে বিদ্রোহ, দোস্ত মহম্মদকে ফের কাবুলে ফিরিয়ে সিংহাসনে বসানো হল। কিন্তু বছর দুয়েক এখানে থেকেই দোস্ত মহম্মদ চমৎকার একটি কাজ করেছিলেন। দূন উপত্যকায় সুগন্ধি বাসমতি চাষ। ওই নির্বাসিত আফগান শাসক না থাকলে আজ সরু, সুগন্ধি দেহরাদূন চালের এই রমরমা হত না।

রামভক্তবাহিনী কথায় কথায় যাঁকে খলনায়ক বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে, সেই জওহরলাল নেহরুর যে এখানে কত অবদান! সেনাবাহিনীর নিয়মে ল্যান্ডর এক ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া, সেখানে নতুন বাড়ি তৈরি করা যায় না। রাস্কিন বন্ড, বিশাল ভরদ্বাজ, প্রণয় রায় থেকে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, সকলে লিজ়-হোল্ডার। সুনীল প্রকাশদের দোকান এখানে বিখ্যাত, নেহরু স্বয়ং এখান থেকে চিজ় কিনতেন। ব্ল্যাকবেরি এখানে স্থানীয় ফল, রাজীব গাঁধী দিল্লি থেকেও ব্ল্যাকবেরি জ্যামের অর্ডার দিতেন। চিজ়, পিনাট বাটার আর ব্ল্যাকবেরি জ্যাম আজও এই দোকানের মুখ্য আকর্ষণ।

সুনীলরা জানালেন, তাঁদের বাবা ইন্দ্রপ্রকাশ এখানে সুইৎজ়ারল্যান্ডের সাহেবদের থেকে প্রথম চিজ় তৈরি শিখেছিলেন। তখন দশ-বারো কিমি দূরের পাহাড় থেকে গোয়ালারা এসে দুধ দিয়ে যেত। চন্দ্রপ্রকাশের আগ্রহ দেখে জেমস ওয়ার্নার নামে এক সাহেব তাঁকে প্রয়াগরাজের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেয়ারি বিভাগে ভর্তি করে নেন। চন্দ্রপ্রকাশ সেখানে দু’শো লিটার দুধের ট্যাঙ্কের আদলে ত্রিশ লিটারের একটা ছোট ট্যাঙ্ক বানালেন। চিজ় বানাতে ইস্পাতের জ্যাকেটে আচ্ছাদিত ট্যাঙ্ক, কাঠের চাপ দেওয়ার যন্ত্র ইত্যাদি লাগে। সেগুলিও তৈরি করলেন। দেড়শো কেজি দুধে তখন কুড়ি কেজি চিজ় হয়। উডস্টক স্কুলের শিক্ষক ভিনসেন্ট হিল শিখিয়ে দিলেন পিনাট বাটার তৈরির কৌশল। নেহরুরা এই দেশজ প্রযুক্তির দোকানটির ভক্ত ছিলেন। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ বা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ গোছের স্লোগান না দিয়েও!

এখন অনিলদের দেহরাদূনের কারখানায় ১১০০ লিটারের দুধের ট্যাঙ্ক। অন্য শহরে চিজ় পাঠান? দু’জনেরই উত্তর, না। ভাল চিজ় ছয় থেকে আট সপ্তাহ ধরে ম্যাচিয়োর করাতে হয়। রেফ্রিজারেশনে স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। প্রশ্ন করলাম, এত যে নামডাক, এখানকার মুখ্যমন্ত্রীরা, পুষ্কর সিংহ ধামী বা তার আগে তীরথ সিংহ রাওয়ত আপনাদের চিজ়-জ্যামের অর্ডার দেন না? সুনীল মুখে কুলুপ আঁটলেন, “না, বিদেশি স্বাদ তো। অনেকেই পছন্দ করেন না।”

বিদেশি স্বাদ? আগে ল্যান্ডরের হটস্পট ছিল লালটিব্বার কাছে ‘চারদুকান’। এক ছাদের নীচে পর পর চারটি দোকান। এখন সেখানে স্প্যানিশ ওমলেটও মেলে না, শুধু চিজ়ের পরতে সাঁতলানো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর বান রুটি। অথচ তিরিশের দশকে উডস্টক স্কুলের প্রিন্সিপালের স্ত্রী অ্যালান পার্কার এখানে কম রেসিপির সন্ধান দেননি। বছর পনেরো আগেও মধু দিয়ে প্যানকেক, ক্রেজ়ি কেক, সুইডিশ অরেঞ্জ কেক খেয়েছি। এখন অন্য সভ্যতা। দেহরাদূনে গাদা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রছাত্রীরা সবাই সপ্তাহান্তে লং ড্রাইভে এখানে। খচাখচ সেলফি। নগর পুড়িলে ল্যান্ডর-মসূরী এড়ায়?

তবু এরই মধ্যে এক দিন যাওয়া গেল শতবর্ষের ঐতিহ্যঋদ্ধ স্যাভয় হোটেলে। সেখানে মধুশালাটির নাম ‘রাইটার্স বার’। রাস্কিন বন্ড, গণেশ সাল্লিরা আছেন। তারও আগে নোবেলজয়ী পার্ল বাক থেকে পিটার হপকার্ক, চার্লস অ্যালেন, কম লেখক এসেছেন এখানে? সিঙ্গাপুরের রাফায়েলস হোটেলে এ রকম এক পানশালা আছে। সেখানে সমারসেট মম থেকে গ্রাহাম গ্রিন, অনেকে যেতেন। ইস, কমলকুমার-সুনীল-শক্তিদের শহরে এখনও নেই কোনও ‘রাইটার্স বার’!

আসলে প্রতিটি পাহাড়ি শহরের আছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। দার্জিলিং, শিমলা বা নৈনিতাল গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। মসূরী সেই আমলাতান্ত্রিক ঝঞ্ঝাটে ছিল না। রেল ও সড়ক যোগাযোগ চমৎকার। ফলে পঞ্জাব ও লাহৌরের রাজারাজড়ারা ছুটি কাটাতে আসতেন। শহরটার মেজাজও সে রকম। অপাপবিদ্ধ ফুর্তি আর নষ্টামি। তিরিশের দশকে পিকচার প্যালেস সিনেমা হলের সামনে এক ব্রিটিশ অভিনেত্রী পাঁচ টাকায় একটি চুমু বিক্রি করতেন। তে হি নো দিবসা গতাঃ। সেই সিনেমা হল এখন জামাকাপড়ের দোকান।

এখন ব্রিটিশরাজ নেই, আভিজাত্য নেই। কলকাতা-দেহরাদূন যাতায়াত করেছি উপাসনা এক্সপ্রেসে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সেকেন্ড এসিতেও বেড রোল নেই, ল্যাপটপ ব্যাগ মাথায় দিয়ে রেক্সিনে মোড়া বার্থে টানটান হওয়া। করোনার অজুহাতে সবই উঠে গিয়েছে। খাবারের মান তথৈবচ। কেলনারের খাবার আশা করি না, কিন্তু পনেরো-কুড়ি বছর আগেও দূরপাল্লার রেলযাত্রা অনেক স্বচ্ছন্দ ছিল।

মসূরী-ল্যান্ডরের পাহাড় থেকে ভারতীয় রেল, সবই এখন বিষণ্ণ অতীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন