প্রতিবাদী: রাষ্ট্রপুঞ্জের সম্মেলনের আবহে জলবায়ু সংক্রান্ত ন্যায়বিচার ও অন্যান্য দাবিতে পথে ব্রাজ়িলের মানুষ। বেলেম, নভেম্বর, ২০২৫। ছবি: রয়টার্স।
শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর’, পরিবেশ নিয়ে এমন কথা গত দু’দশকে খুবই প্রচারিত। মনে পড়তে পারে, বেশি দিন আগে নয়, সুইডেনের এক কিশোরী দূষণ-বিরোধী প্ল্যাকার্ড নিয়ে সুইডিশ সংসদ ভবনের সামনে একাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, পরে সে হয়ে উঠেছিল পরিবেশ আন্দোলনের প্রধান মুখ। সম্প্রতি দেখা গেল, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিবাদ করতে এসে তরুণ-তরুণীরা ল্যুভর মিউজ়িয়মে ‘মোনালিসা’ ছবিতে নোংরা মাখিয়ে দিচ্ছে।
আপাতত এই নিয়ে মুখরিত বিজ্ঞান সমাজবিদ্যা অর্থনীতি রাজনীতি— সব মহল। মূল বক্তব্য, পরিবেশ দূষণের মূল দায়— জীবাশ্ম জ্বালানি— মূলত কয়লা, তেল ও গ্যাস। প্রসঙ্গত, কয়লা জ্বালিয়েই ঘটেছিল ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব যা গড়ে দিয়েছিল আজকের উন্নত বিশ্বের ভিত্তিভূমি। কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির দহনে নির্গত কার্বন উদ্গিরণে বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন। অতিবৃষ্টি, খরা, উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলসঙ্কট, ঝড়, অত্যধিক শৈত্য— সব ঝামেলার একটাই উৎস, জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু এও আমাদের ভাল করে বিবেচনা করা দরকার, এ সব কি সত্যিই শেষের সে দিনের সঙ্কেত?
এই প্রসঙ্গে এক নতুন মাত্রা আনল সিওপি৩০, রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যা কিছু দিন আগেই সমাপ্ত হয়েছে ব্রাজ়িলের বেলেম শহরে। এই প্রথম এই সম্মেলন-শেষের ঘোষণাপত্রে জীবাশ্ম জ্বালানির কোনও উল্লেখ থাকল না। বারো দিনের সম্মেলনে আগাগোড়া বিষয়টি নিয়ে বেশ হইচই টানাপড়েন চলেছে, স্বাভাবিক ভাবেই। দু’বছর আগে দুবাইয়ে সিওপি২৮ সম্মেলনের ঘোষণায় ২০৫০-এর মধ্যে একেবারে শূন্য কার্বন উদ্গিরণের কথা বলা হয়েছিল, সিওপি২৯-এ ইউরোপীয় দেশগুলি-সহ ২৫টি দেশ বলেছিল তাদের পরবর্তী শক্তি পরিকল্পনা কয়লা বাদ দিয়েই করবে। কিছু দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির উপর ভর্তুকি বন্ধ করবে ইত্যাদি। কিন্তু এ বার চিন, ভারত, রাশিয়া, সৌদি আরব মিলে ভেস্তে দিল এত দিনের পরিকল্পনা, তাদের প্রতিবাদে জীবাশ্ম জ্বালানি কথাটাই থাকল না সম্মেলনের ঘোষণায়। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশ এই ঘোষণা মানেনি, তারা আলাদা একটি গোষ্ঠী গঠনের কথা ভাবছে।
ভারত সব সময়ই পরিবেশ ও উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্যের কথা বলে এসেছে। ১৯৭২ সালে প্রথম রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি বার্তা দিয়েছিলেন— দারিদ্রই সবচেয়ে বড় দূষক। কথাটা এখনও প্রাসঙ্গিক। গত কয়েক দশকে ভারত তার শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রায় ৫০ শতাংশ পুনর্নবীকরণযোগ্য ক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু দ্রুত উন্নয়ন ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির সহায়ক হিসাবে জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষত কয়লার গুরুত্ব অনেক। আর পশ্চিমি পরিবেশবাদীদের আক্রমণের মূল লক্ষ্যই কয়লা।
এই সম্মেলনে পৃথিবীর সব দেশের জন্য একই জীবাশ্ম জ্বালানির নিয়ম মানতে অস্বীকার করেছে ভারত। বেশ অনেক বছর ধরেই বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য পশ্চিমি দেশগুলির ঐতিহাসিক দায়ভার লাঘব করতে উষ্ণায়ন রোধে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে অর্থ ও প্রযুক্তি দেওয়ার বিষয়টি এগোচ্ছে না। এ নিয়ে দাবিদাওয়াতেও ভারত সরব হয়েছে। অর্থ দেওয়ার প্রধান ভান্ডারি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা এ বার সম্মেলনে আসেনি, কেননা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘জলবায়ু পরিবর্তনের হুজুগ’-এর ঘোষিত বিরোধী।
কিন্তু পরিবেশের জগতে এই নতুন হাওয়া কি স্বাভাবিক, অনেকেই কি নতুন ভাবে ভাবছেন? বিশ্বের বিজ্ঞান প্রযুক্তি জগতের দুই পথিকৃৎ এবং ধনকুবের বিল গেটস এবং ইলন মাস্ক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তাঁদের মনোভাব পরিবর্তন করেছেন। এক সময় এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন এবং অনেক অর্থ ব্যয়কারী বিল গেটস জলবায়ু পরিবর্তন যে ভয়ঙ্কর, এখন আর তা মনে করেন না। একে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মেনে নিয়েও তিনি বলেছেন আরও বেশি প্রাধান্য দেওয়া দরকার— দারিদ্র ও রোগ দূরীকরণে। ইলন মাস্ক বলছেন যে, জীবাশ্ম জ্বালানিকে ভয়াবহ বলে দেখানো ঠিক নয়, জলবায়ু পরিবর্তনকে অশনিসঙ্কেত বলাও বাড়াবাড়ি। বিজ্ঞানী মহলেও এখন মনে করা হচ্ছে যে, ভবিষ্যতের যে সব ছবি আঁকা হচ্ছে, তা বিভিন্ন গাণিতিক মডেলকে ভিত্তি করে, যার অনেকগুলিই নানা অনিশ্চয়তায় ভরা।
এ বিষয়ে ডেনমার্কের পরিবেশবিদ বিয়র্ন লমবর্গ-এর দীর্ঘ দিনের মত যে, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তব ঘটনা। কিন্তু তার মোকাবিলায় যে আগ্রাসী পদ্ধতি গ্রহণ করা হচ্ছে, তা সাধারণ মানুষের উন্নত জীবনযাপনের মান অর্জনের বিরুদ্ধাচরণ। এখনও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন ব্যয়সাপেক্ষ এবং দ্রুত উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয়। ভারতের জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পশ্চিমি দেশগুলির চাপিয়ে দেওয়া জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন শর্ত মানতে গিয়ে প্রকল্পের খরচ বেড়ে যায়। এ সবের জন্য সরকারি ভর্তুকির অর্থ জোগাতে টান পড়ে উন্নয়ন প্রকল্পে। এখন ভারতের জনপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহার ১৪০০ কিলোওয়াট প্রতি ঘণ্টা, পশ্চিমবঙ্গে ৬০০। আমেরিকার ১৩০০০ কিলোওয়াট প্রতি ঘণ্টা, তাইল্যান্ডে ২৭০০। পশ্চিমবঙ্গে এখন দশটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। তা বাড়িয়ে কুড়িটি হলে আমরা ভারতের মানে পৌঁছব। আরও দু’শোটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে আমেরিকার মানে পৌঁছব। আর এত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চাই কয়লা, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি এখনও এই সহায়তায় সমর্থ নয়। লমবর্গের মতে, ‘শূন্য জীবাশ্ম জ্বালানি নীতি’ মানে গরিবের মৃত্যু। অর্থাৎ, যাঁরা এত দিন কয়লা-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ দিয়ে এসি চালিয়ে বাড়ি-অফিস করছেন, শীতে হিটার জ্বালাচ্ছেন, তাঁরা নিশ্চিন্তে থাকবেন আর গরিব মানুষকে ভরসা করতে হবে— কবে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন যথেষ্ট বেড়ে তাঁদের ঘরের টিমটিমে আলোটি উজ্জ্বল করবে।
চিনের পথ আমাদের পথ— এ ছিল এক সময় পশ্চিমবঙ্গের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা স্লোগান। জলবায়ু পরিবর্তন ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপারে চিনকে আমরা অনুসরণ করতেই পারি। এ বারের সিওপি৩০-এ আমেরিকার অনুপস্থিতিতে চিনই ছিল প্রধান ভূমিকায়। চিন অনেক দিন ধরেই নিজের দেশের উন্নতিকে প্রাধান্য দিয়েও আন্তর্জাতিক স্তরে পরিবেশবান্ধব রূপটিকে অনেকটাই ধরে রেখেছে। সারা পৃথিবীতে সৌরশক্তি উৎপাদনের যাবতীয় যন্ত্রপাতির ৯০ শতাংশ আসে চিন থেকে। অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের আবহে চিন একচেটিয়া ব্যবসা করছে। কিন্তু চিন নিজে শুধু সৌরশক্তির উপর নির্ভর করছে না। সৌরশক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু করার পর গত এক দশকে চিনে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
অর্থাৎ স্বদেশের উন্নয়নের জন্য পশ্চিমের পরিবেশ-বিলাসকে গ্রাহ্য করছে না চিন। কিন্তু পরিবেশ উন্নয়নে সে পিছিয়েও নেই। উন্নয়নশীল ভারতের কাছে এখনও উন্নত জীবনমান থেকে পিছিয়ে পড়া কোটি কোটি মানুষকে আলোকময় জীবনে নিয়ে আসতে চিনের পথই ভরসা, অবশ্যই চিনের একনায়কতন্ত্রকে বর্জন করে। সৌরশক্তি উৎপাদনে ভারত চিন, আমেরিকার পর বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। অতি সম্প্রতি তেলে স্বনির্ভর হতে কানাডা সরকার তার জলবায়ুনীতি পরিবর্তন করে তেল উৎপাদন ও নতুন তেলের পাইপলাইন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে।
সিওপি৩০-এর ইঙ্গিতের পর পরিবেশবাদীরা হয়তো বাস্তবতায় ফিরবেন। অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানি খনন হতে হবে পরিবেশ আইন মেনে, উপযুক্ত পুনর্বাসন দিয়ে। শেষ হোক ভয় দেখানো ভবিষ্যদ্বাণী। বাস্তববোধ বাড়ুক।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে