শাস্তি মকুবের পিছনে
Bilkis Bano

বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তি: যেখানে আইনের ফাঁক থেকে গেল

হাঁসখালি থেকে হাথরস, মেয়েরা ক্ষমতার অসাম্যের জাঁতাকলে পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হন, ক্ষমতাবানরা আইনের ফাঁক গলে উদ্ধার করে নিয়ে যান অপরাধীদের।

Advertisement

শমীক সেন

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:৩৪
Share:

দাবি: বিলকিস বানো মামলায় অপরাধীদের মুক্তির প্রতিবাদে বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের সদস্যদের বিক্ষোভ। ২৮ অগস্ট, গুরুগ্রাম। পিটিআই

ওরা অপরাধ করেছে কি না, আমি জানি না... ওদের পরিবারের কাজকর্ম অত্যন্ত ভাল; ওরা ব্রাহ্মণ, আর ব্রাহ্মণ বলেই ওদের মূল্যবোধও অত্যন্ত উঁচু দরের।” এমন কথাই বলেছেন গুজরাতের বিজেপি বিধায়ক সি কে রাউলজি। তিনি আবার সেই বোর্ডেরও সদস্য, যারা ২০০২ সালের ৩ মার্চ ২১ বছর বয়সি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানোর উপর হওয়া নৃশংসতম গণধর্ষণ, তাঁর তিন বছরের মেয়ে-সহ পরিবারের সাত সদস্যকে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ১১ জন অপরাধীকে মুক্তি দিয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, মুক্তির নির্দেশটি দেওয়া হল এই বছরের ১৫ অগস্ট, যে দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘আজ়াদি কা অমৃত মহোৎসব’-এ তাঁর স্মারক বক্তৃতায় লাল কেল্লা থেকে দৃপ্ত কণ্ঠে দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন যে, “জরুরি হল, আমাদের কথায় এবং ব্যবহারে, আমরা এমন কিছু করব না যা নারীর সম্মানকে খাটো করতে পারে।”

Advertisement

মেয়েদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের প্রশ্নে শাসক দলের কথায় ও কাজে এমন অসেতুসম্ভব দূরত্ব নতুন কিছু নয়। পশ্চিমবঙ্গই হোক বা উত্তরপ্রদেশ, যে দলের শাসনই হোক, বহু ভয়ঙ্কর ঘটনায় শাসকদের কণ্ঠে অভিযুক্তদের প্রতি প্রশ্রয়ের সুর, অথবা নির্যাতিতার প্রতি কটাক্ষ শোনা গিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের মাথায় সর্বোচ্চ ক্ষমতাবানদের অভয়হস্ত থাকে। হাঁসখালি থেকে হাথরস, মেয়েরা ক্ষমতার অসাম্যের জাঁতাকলে পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হন, ক্ষমতাবানরা আইনের ফাঁক গলে উদ্ধার করে নিয়ে যান অপরাধীদের।

বিলকিস বানো মামলায় অপরাধীদের মুক্তির প্রসঙ্গে ফিরে আসি। প্রথমে দেখা যাক, এই ক্ষেত্রে আইন কী বলছে। ‘কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর, ১৯৭৩’-এর ৪৩২ এবং ৪৩৩ নম্বর ধারায় মুক্তির বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। ৪৩৩এ ধারায় বলা আছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি অন্তত চোদ্দো বছর জেলে না কাটালে তাকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। তবে মুক্তির নির্দেশের ক্ষেত্রে কিছু শর্তসাপেক্ষ দৃষ্টান্ত আছে, কাউকে মুক্তি দিতে গেলে যা মেনে চলতে হবে। ৪৩২(৭) ধারা অনুযায়ী, ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট গভর্নমেন্ট’ বা ‘সংশ্লিষ্ট সরকার’ মুক্তির এই নির্দেশ দিতে পারে। সংশ্লিষ্ট সরকার বলতে বোঝানো হয়েছে সেই রাজ্য সরকারকে, যার ভৌগোলিক আওতায় বিচারপ্রক্রিয়া ও শাস্তিদানের সিদ্ধান্তটি হয়েছে। ৪৩২(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনও শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধী মুক্তির আবেদন করলে, যে বিচারপতি তাকে দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন, সরকার চাইলে তাঁর মতামত নিতে পারে যে, আদৌ এই আবেদনটি গ্রাহ্য করা উচিত কি না। এবং, কেন বিচারপতি সেই আবেদনের পক্ষে বা বিপক্ষে মত দিচ্ছেন, সেই কারণটিও জানতে হবে। আইন যদিও বলছে যে, ‘সরকার চাইলে এই মতামত নিতে পারে’, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের একাধিক ব্যাখ্যায় (যার মধ্যে শ্রীহরণ বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র মামলা, অর্থাৎ রাজীব গান্ধী হত্যা ষড়যন্ত্র মামলাও রয়েছে) এটা স্পষ্ট যে, সংশ্লিষ্ট বিচারকের মতামত গ্রহণের শর্তটি কার্যত বাধ্যতামূলক। তা ছাড়াও, যে ক্ষেত্রে সংসদে পাশ হওয়া আইনভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে, এবং যেখানে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা মামলার তদন্ত করেছে— বিলকিস বানো মামলায় যেমন ঘটেছে— সে ক্ষেত্রে, আইনের ৪৩৫ ধারা অনুসারে, অপরাধীর সাজা মকুব করার আগে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি গ্রহণও বাধ্যতামূলক।

Advertisement

অর্থাৎ, তথ্যগুলি খুঁটিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয় যে, এই ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ার বিধি ভঙ্গ করা হয়েছে, এবং তার ফলেই অপরাধীদের মসৃণ ভাবে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। দাঙ্গাবিধ্বস্ত গুজরাতে যখন প্রথম এই মামলায় অভিযুক্তদের বিচারের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়, তখন সুপ্রিম কোর্ট অনুভব করেছিল, যে আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ রয়েছে, তার মধ্যে নিষ্পক্ষ ও ন্যায্য শুনানি সম্ভব নয়। অতঃপর এই মামলাটিকে গুজরাত থেকে সরিয়ে মহারাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং মুম্বই দায়রা আদালতের এক বিচারক শেষ পর্যন্ত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। অতএব, এটা স্পষ্ট যে, এই মামলায় ‘সংশ্লিষ্ট সরকার’ বলতে কখনওই গুজরাত সরকারকে বোঝায় না, সেই সরকারটি হল মহারাষ্ট্র সরকার। শ্রীহরণ মামলায় তৎকালীন বিচারপতি ইউ ইউ ললিত (বর্তমানে ভারতের মাননীয় প্রধান বিচারপতি) অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে এই ব্যাখ্যাটি পেশ করেন। তিনি বলেন যে, কোনও অপরাধ যদি ক রাজ্যে ঘটে থাকে, কিন্তু সেই মামলার বিচার যদি খ রাজ্যের আদালতে হয় এবং সেই আদালতই যদি দণ্ডাদেশ দেয়, তবে এই ক্ষেত্রে দ্বিতীয় রাজ্যটিকেই অ্যাপ্রোপ্রিয়েট গভর্নমেন্ট বা সংশ্লিষ্ট সরকার হিসাবে গণ্য করতে হবে। কেউ বলতে পারেন যে, সেই মামলায় বিচারপতি ললিতের রায়টি চরিত্রে ছিল পার্শিয়াল ডিসেন্টিং ওপিনিয়ন, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের মূল রায়ের সঙ্গে তাঁর রায়ের বিরোধ ছিল। মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, মূল রায়ের সঙ্গে বিচারপতি ললিতের মতদ্বৈধ ছিল আইনের অন্য কিছু ব্যাখ্যা নিয়ে, অপরাধীর শাস্তি মকুবের ক্ষেত্রে ‘সংশ্লিষ্ট সরকার’-এর সংজ্ঞা কী হবে, তা নিয়ে নয়। কাজেই, তাঁর এই পর্যবেক্ষণটিকে সুপ্রিম কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের রায় হিসাবেই গণ্য করা বিধেয়, এবং সেই রায় যে কোনও ক্ষুদ্রতর বেঞ্চ মানতে বাধ্য।

কিন্তু, রাধেশ্যাম ভগবানদাস শাহ বনাম গুজরাত রাজ্য মামলায় অপরাধীদের এক জন যখন সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানাল যে, এই মামলায় গুজরাতকেই সংশ্লিষ্ট সরকার হিসাবে বিবেচনা করা হোক, সুপ্রিম কোর্ট সেই যুক্তিতে স্বীকৃতি দিল। বিচারপতি রাস্তগি ও বিচারপতি নাথের দুই সদস্যের বেঞ্চ মত দিল যে, এই ক্ষেত্রে যে রাজ্যে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে, সেই রাজ্যকেই ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট গভর্নমেন্ট’ বা ‘সংশ্লিষ্ট সরকার’ হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে, কারণ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মামলার বিচার সেই রাজ্যেই হওয়ার কথা। শীর্ষ আদালতের মতে, মামলাটিকে ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে এবং শুধুমাত্র বিচারের সীমিত উদ্দেশ্যে মহারাষ্ট্রে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। যে-হেতু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই মামলার বিচার গুজরাতেই হওয়ার কথা ছিল, এবং যে-হেতু বিচারের পর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের গুজরাতের কারাগারেই পাঠানো হয়, অতএব এই মামলাটি গুজরাত সরকারের এক্তিয়ারেই পড়ে। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও বলা প্রয়োজন যে, এই ব্যাখ্যাটি শীর্ষ আদালতের শ্রীহরণ মামলার রায়ের সঙ্গে সমঞ্জস নয়। এ ছাড়াও, যে-হেতু এই মামলার তদন্ত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা করেছিল— ফলে, এই ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি মকুব করতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি গ্রহণ প্রয়োজন; যে বিচারক এই দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন, তাঁরও সম্মতি প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে সেই সম্মতিগুলি গ্রহণ করা হয়েছিল কি না, তার কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই। বরং, সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, সংশ্লিষ্ট বিচারক এই ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি মকুবের বিরোধীই ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে স্বচ্ছ তথ্যপ্রমাণের অভাব আরও এক বার এই শাস্তি মকুবের সিদ্ধান্তের অসঙ্গতি ও বেআইনি চরিত্রের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে।

এই কারণগুলি থেকে বোঝা যায় যে, অপরাধীদের শাস্তি মকুবের সিদ্ধান্তটিতে বিপুল পদ্ধতিগত ও বস্তুগত ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর প্রশ্নটি হল, অপরাধীদের মুক্তির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে যে মামলাগুলি হয়েছে, তার শুনানির সময় যদি বিচারবিভাগ এই মুক্তিসংক্রান্ত আইনকে যথাযথ পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করে, এবং পূর্বের ভ্রান্তি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়, প্রকৃত প্রস্তাবে কি তা শাসকদের মানসিকতা পাল্টাতে পারবে? প্রশ্নটি যদি সহজ না-ও হয়, তার উত্তর তো জানা।

আইনবিদ্যা বিভাগ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন