Quantum

কোয়ান্টাম তত্ত্বের শতবর্ষে

কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে তৈরি হচ্ছে নতুন বিস্ময়কর প্রযুক্তি। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন সব গণনা করতে পারে, যার সামনে আজকের সুপারকম্পিউটারকে শিশু মনে হয়।

আরণ্যক গোস্বামী

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:১০
Share:

ফুলের পরাগ থেকে অ্যালার্জি কিছুতেই সারছে না, তাই নাচার হয়ে এক তরুণ বিজ্ঞানী কোপেনহেগেন ছেড়ে চলে গেলেন উত্তর সাগরের দ্বীপ হেলগোল্যান্ডে। ভের্নার হাইজ়েনবার্গ তার আগে বছর দুয়েক কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিলস বোর-এর সঙ্গে গবেষণা করছিলেন পদার্থবিদ্যায়। একা সেই দ্বীপে বসে পঁচিশ বছরের হাইজ়েনবার্গ লিখে ফেলেছিলেন এমন এক সমীকরণ, যা বিজ্ঞানের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হল সেপ্টেম্বর, ১৯২৫ সালে। জন্ম নিল কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এ বছর এই তত্ত্বের একশো বছর উদ্‌যাপিত হচ্ছে।

এই তত্ত্ব আমাদের শিখিয়েছে যে বাস্তব কোনও দৃঢ় কাঠামোয় আবদ্ধ নয়, বরং সম্ভাবনার অসীম এক ভান্ডার। পদার্থের কণারা একই সঙ্গে একাধিক অবস্থায় থাকে। আমরা যখন তাদের মাপি, সে সময়ে বিভিন্ন সম্ভাবনার ভিড় থেকে একটিমাত্র অবস্থা বেরিয়ে আসে। এই অদ্ভুত তত্ত্ব মেনে নিতে অনেকেরই অসুবিধে হয়েছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক জগতে তা নির্ভুল বলে গৃহীত হয়েছে। তবু একশো বছর পেরিয়েও বিভ্রান্তি কমেনি। কেউ বলছেন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব বহু জগতের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে প্রতিটি সম্ভাবনাই কোথাও না কোথাও সত্য। কেউ আবার মনে করেন, এগুলো কেবল তত্ত্ব, পর্যবেক্ষকদের ব্যাখ্যা, বাস্তব সত্য নয়।

এ বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে যে তিন বিজ্ঞানীকে— জন ক্লার্ক, মিশেল এইচ ডেভোরেট এবং জন এম মার্টিনিস— তাঁরা পরীক্ষামূলক ভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্বের সত্যতার প্রমাণ দেখাতে পেরেছেন, এবং বৈদ্যুতিক সার্কিটের মধ্যে কোয়ান্টাম কণার আচরণ দেখা গিয়েছে খালি চোখেই। মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়নি। একটি বিশেষ আবিষ্কার হল ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং’, যেখানে কণাগুলি একটি বাধাদায়ী অবচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে এমন ভাবে চলে যাচ্ছে, যেন কোনও অবচ্ছেদ নেই। তাঁরা আরও দেখিয়েছেন, কণাগুলি শক্তি (এনার্জি) শুষে নেয় এবং ছেড়ে দেয় একেবারে নির্দিষ্ট হারে, যেমনটি বলা হয়েছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বে।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে তৈরি হচ্ছে নতুন বিস্ময়কর প্রযুক্তি। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমন সব গণনা করতে পারে, যার সামনে আজকের সুপারকম্পিউটারকে শিশু মনে হয়। কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে জটিল অণুর আচরণ বোঝা, নতুন ওষুধ আবিষ্কার, এমনকি জলবায়ুর ভবিষ্যৎ অনুমান করা সম্ভব হবে। ঘড়ির জগতে তৈরি হচ্ছে এমন ‘নিউক্লিয়ার ক্লক’, যা মহাবিশ্বের বয়সের থেকেও দীর্ঘ সময় মাপতে গিয়ে এক সেকেন্ডও ভুল করবে না। ‘কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি’ দেবে নিরাপত্তা, যেখানে তথ্য চুরি প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।

কোয়ান্টামের প্রয়োগ এখন জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। জীবিত কোষের ভিতরে কোয়ান্টাম সেন্সর তৈরি করা সম্ভব হয়েছে প্রোটিনের মাধ্যমে। অর্থাৎ জীবজগতেও কোয়ান্টামের প্রভাব কাজ করতে পারে। পরিযায়ী পাখির পথ চেনার ক্ষমতা, গাছের সালোকসংশ্লেষ কিংবা কিংবা গন্ধ গ্রহণের মতো প্রক্রিয়াকে বোঝার জন্য কোয়ান্টাম ব্যাখ্যা নতুন জানলা খুলছে। মেশিন লার্নিং-এর কাজও কোয়ান্টাম পদ্ধতি দিয়ে আরও দ্রুত ও দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। নির্দিষ্ট ধরনের বিভাজন মেশিনকে শেখানোর কাজ প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অনেক দ্রুত করা যাচ্ছে কোয়ান্টাম পদ্ধতিতে। ‘ক্লাসিক্যাল শ্যাডো’ ও ‘কোয়ান্টাম মেমরি’-র মতো কৌশলে কম ডেটা ব্যবহার করে অনেক তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে।

কিন্তু চ্যালেঞ্জও কম নয়। কোয়ান্টাম ব্যবস্থা অত্যন্ত সংবেদনশীল, পরিবেশের ক্ষুদ্রতম কম্পন বা তাপমাত্রার পরিবর্তনেই তথ্য নষ্ট হয়ে যায়। তাই এক দিকে যেখানে সম্ভাবনার দরজা খুলছে, অন্য দিকে তা ধরে রাখার লড়াইও ক্রমশ কঠিন হচ্ছে।

একশো বছরে কোয়ান্টামের অগ্রগতির গল্পটা যেন মানুষের যাত্রার প্রতিচ্ছবি। আমরা অজানার পিছনে ছুটি, জানি এই অজানা আমাদের কাঁধে নতুন দায়িত্বও চাপিয়ে দেবে। যে কোনও প্রযুক্তির মতোই এ ক্ষেত্রেও সাফল্যের পাশাপাশি বাড়ছে ঝুঁকি। শক্তিশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে আজকের সব তথ্য লুকোনোর জন্য ব্যবহৃত ‘এনক্রিপশন’ পদ্ধতি মুহূর্তে ভেঙে ফেলা যাবে। ব্যাঙ্কের নথি, ব্যক্তিগত তথ্য, রাষ্ট্রের গোপন ফাইল, সবই সুরক্ষার বাইরে চলে যেতে পারে। ফলে অর্থের লেনদেন থেকে শুরু করে জাতীয় সুরক্ষার কাঠামো পর্যন্ত ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে নীতি নির্ধারণেরও সমান গুরুত্ব রয়েছে। পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে এক সময় আন্তর্জাতিক চুক্তি দরকার হয়েছিল, তেমনই কোয়ান্টাম-এর শক্তিকে কী ভাবে কাজে লাগানো হবে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া জরুরি।

কোয়ান্টামের শতবর্ষ তাই এক দিকে উদ্‌যাপন, অন্য দিকে সতর্কতার সঙ্কেত। আর হয়তো সত্য এটাই— কোয়ান্টাম তত্ত্ব-কথিত অনিশ্চয়তা কেবল পদার্থকণার নয়, মানবসমাজের বাস্তব পরিস্থিতিরও সবচেয়ে সঠিক প্রতিফলন। প্রশ্ন হল, আমরা কি কেবল ক্ষমতার উদ্‌যাপন করব, না কি এই অপরিমেয় শক্তিকে ভবিষ্যতের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য দ্রুত একটি নৈতিক কাঠামো তৈরি করব?

ইউনিভার্সিটি অব আরকানস’, বায়োটেকনোলজি বিভাগ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন