Iran Hijab Row

বেঁচে থাকার চেয়ে বড় ধর্ম নেই

পোশাকহীন উন্মুক্ত নারীদেহে অনেকেই লিখে নিয়েছেন মাহশা আমিনি-র নাম। চলছে জমায়েত, পথ-নাটক, গান। প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন ইরানের বহু পুরুষ।

Advertisement

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৪২
Share:

প্রতিবাদ।

জলঙ্গি নদীর বাঁধের উপরে জঙ্গল। নীচে সরু রাস্তা। দু’পাশে কয়েকটা টিনের চালার ঘর। সন্ধেবেলা, কখনও বা রাতের দিকে সেই রাস্তা ধরে ঢুকে আসে ট্রলি-ভর্তি খাবার। কৃষ্ণনগরের অনেকেই নিজের বাড়ির উৎসব বা কোনও অনুষ্ঠান শেষে বেঁচে যাওয়া অতিরিক্ত খাদ্যাদি নিয়ে আসেন এখানে। ‘খাবার এনেছি’ বলে ডাক দেন ট্রলিচালক। শুরু হয় বাচ্চাদের হুড়োহুড়ি। ট্রলির চার পাশে থালা হাতে এসে দাঁড়ান স্থানীয় মানুষজন। কার বাড়ি উৎসব ছিল? হিন্দু? মুসলমান? খ্রিস্টান? না কি, শিখ? বিয়ে-শাদি ছিল কারও? জন্মদিন? না কি কোনও শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠানের খাবার এ সব? জানতে চান না কেউ। বদলে তাঁরা প্রশ্ন করতে থাকেন, “মাছ আছে আর? মিষ্টি? আমায় আর একটা আইসক্রিম দেবেন ভাই?” এই দৃশ্য দেখলে মনে হয়, মানুষের বাঁচার ইচ্ছাটুকুই তাঁর একমাত্র ধর্ম!

Advertisement

কিন্তু, যখন দেখি যে, উচ্চবর্ণের শিক্ষকদের পাত্র থেকে জল পান করার ‘অপরাধ’-এ এক ন’বছরের দলিত বালককে পিটিয়ে মেরে ফেলেন এক শিক্ষক; ভিন ধর্মে বা জাতে ভালবেসে বিয়ে করেছেন বলে হত্যা করা হয় প্রণয়ীকে; গণেশ চতুর্থীর বিসর্জনের আবির গালে লেগে আছে বলে নিজধর্মের এক যুবককে খুনই করে ফেলে এক দল মুসলমান; অথবা কেউ কৃষ্ণাঙ্গ বলে, কেউ মুসলমান বলে, কেউ সমকামী বলে বা অন্য যে কোনও কারণে মেরেই ফেলা যায় এক জন মানুষকে— এই সব ঘটনার সাক্ষী হতে হতে বারে বারে ভয় হতে থাকে।

ভয় হয়, তা হলে কি এই বিদ্বেষই সত্য, বেঁচে থাকার ধর্মের চেয়ে আরও অনেক প্রবল? না কি, গোষ্ঠীগত বা রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষ ও দমনের হাতে মার খেতে খেতেও মানুষ এক বার কোনও মতে বেঁচে নিতে চায়? নিঃশ্বাস নিতে চায় শুধু মানুষ হিসাবেই? ১৩ সেপ্টেম্বর ইরানের রাস্তায় ঠিক ভাবে হিজাব না-পরার অপরাধে রাষ্ট্র-পোষিত নীতিপুলিশ বা ‘গাশত-ই-এরশাদ’-এর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন বাইশ বছরের মাহশা আমিনি। পুলিশি ক্যাম্পে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের পর তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে গোটা দেশ যে বিপুল বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, তা কি আসলে প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়ার মরিয়া চেষ্টাই নয়? প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন যাঁরা, সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তাঁরা কি নিজেদের মানুষ সত্তাকেই ঠাঁই দেননি— অবদমিত, রাষ্ট্রের কাছে মাথা হেঁট করে থাকতে বাধ্য হওয়া মানুষের সত্তা? এক মাসের বেশি সময় ধরে তাঁরা কি শুধু নিজেদের অখণ্ড মানবসত্তাটুকুর অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই লড়ে যাচ্ছেন না?

Advertisement

পোশাক ও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে ইরান-শাসক রেজা শাহ পাহলভি ছিলেন পাশ্চাত্যরুচির অনুসারী। তাই তিনি ১৯৩৬ সালের ৮ জানুয়ারি ‘কাশফ-ই হিজাব’ আইনের মাধ্যমে ইরানে যাবতীয় পর্দা-প্রথা নিষিদ্ধ করেছিলেন। রেজা-র শাসনপর্বে, কেউ নিজের ইচ্ছায় হিজাব পরে রাস্তায় বেরোলে পুলিশ তা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিত। সেই একই স্বৈরাচারের অন্য রূপ এখন ইরানে দেখতে পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের এক ইরানীয় সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের প্রধান অংশের মেয়েরা হিজাবের বিরুদ্ধে। অথচ, ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পরেই, আয়াতোল্লা খোমেনি ঘোষণা করেন, সাত বছরের ঊর্ধ্বে সমস্ত মেয়ে কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে, হিজাব পরে, তবেই জনসমক্ষে বাইরে বেরতে পারবেন। এই শরিয়তি আইনের অন্যথা হলে, ইসলামিক দণ্ডবিধি অনুযায়ী তিন প্রকারের শাস্তির উল্লেখ আছে। এক, কারাদণ্ড। দুই, জরিমানা। তিন, বেত্রাঘাত।

আমিনি-র মৃত্যু তোলপাড় করে দিয়েছে ইরানকে। যে-হিজাব ঠিকভাবে না-পরার অপরাধে মরতে হয়েছে আমিনিকে, এত দিনের সেই শৃঙ্খল-পোশাক প্রকাশ্য রাস্তায় মেয়েরা নিক্ষেপ করছেন আগুনে। নিজেদের চুল কেটে পতাকা হিসেবে উড়াল দিচ্ছেন হাওয়ায়। পোশাকহীন উন্মুক্ত নারীদেহে অনেকেই লিখে নিয়েছেন মাহশা আমিনি-র নাম। চলছে জমায়েত, পথ-নাটক, গান। প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন ইরানের বহু পুরুষ। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও যোগ দিচ্ছে এ বার।

নিজের দেশ ইরান সম্পর্কে ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামি বলেছিলেন, “ধর্ম অতি ব্যক্তিগত বিষয়। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য হল, ধর্মের সেই ব্যক্তিগত দিকটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।” ব্যক্তির সেই ‘পার্সোনাল অ্যাসপেক্ট’ ইরানের মেয়েদের প্ল্যাকার্ড হাতে চিৎকার করে বলা ‘উইমেন লাইফ ফ্রিডম’ কথাটির মধ্যে দিয়েই এখন জেগে উঠছে যেন।

‘ধর্ম’ শব্দটির অনেক অর্থের মধ্যে একটি হল: ধারণ করা। আমাদের মনের ভিতরের সেই ধারণপাত্রটির মধ্যে আমরা তবে কী রাখব? ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঘৃণাশিক্ষা? বিধিনিষেধ? কলহ? না কি, ধারণ করব বেঁচে থাকার অদম্য তাগিদটুকু, যা শেষ পর্যন্ত সব বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে কখনও ক্ষুধার পরিচয়ে, কখনও অবদমনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে মিলিয়ে দিতে থাকবে অন্য সব বিভাজনকে? সেই পরিচয়, যা কৃষ্ণনগরের প্রায়ান্ধকার গলিকে অনায়াসে মিলিয়ে দিতে পারে তেহরানের রাস্তার সঙ্গে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন