‘আমাদেরই লোক’?
Minority Community

প্রধানমন্ত্রী মোদীর পসমন্দা পর্ব: এ বার কি নতুন মুসলিম নীতি 

জুলাই মাসে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পিছিয়ে পড়া এই ১৬-১৭ কোটির জন্য দলকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

Advertisement

শুভজিৎ বাগচী

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ ০৬:০০
Share:

‘ওরা’: মুসলমান সমর্থক আকর্ষণের প্রচেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, দিল্লি, ১ নভেম্বর ২০১৪

লখনউয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক সম্মেলনে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি অভাবনীয় একটি ঘটনা ঘটেছিল। গেরুয়া পাগড়ি আর উত্তরীয় পরা মুসলিম প্রতিনিধিদের দেখা গিয়েছিল ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান দিতে। সম্মেলনটির আয়োজন হয়েছিল ‘পসমন্দা’ মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের জন্য। পসমন্দা একটি ফারসি শব্দ, যার অর্থ পশ্চাৎপদ বা পিছিয়ে পড়া। ভারতে ২০ কোটি মুসলমানের মধ্যে ১৬-১৭ কোটি (৮০-৮৫%) নাকি পিছিয়ে পড়া পসমন্দা।

Advertisement

গত জুলাই মাসে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পিছিয়ে পড়া এই ১৬-১৭ কোটির জন্য দলকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর আহ্বান অবাক করেছিল সাধারণ মানুষকে তো বটেই, দলের কর্মী-নেতাদেরও। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পরে বিজেপি রাতারাতি পসমন্দাদের মধ্যে গিয়ে কাজ করতে শুরু করে। লখনউ বৈঠক তারই ফল।

মুসলমান সমাজ ভারতে তিন ভাগে বিভক্ত। এর শীর্ষে রয়েছে সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী আশরাফ। মাঝের শ্রেণিতে আজলাফ এবং একেবারে নীচে আরজাল, হিন্দু ধর্মে যাদের শূদ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হিন্দু বর্ণব্যবস্থা ইসলামকে প্রভাবিত করে কি না এ নিয়ে অনেক তর্কবিতর্কের পরে মোটামুটি ভাবে মনে করা হয়, পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে বর্ণব্যবস্থা ইসলামকে প্রভাবিত করে। আজলাফ এবং আরজালকে এক সঙ্গে পসমন্দা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে এটি ঘোষণা করা হয়নি।

Advertisement

অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেিণর (‘আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস’ বা ওবিসি) কিছু সুযোগ-সুবিধা পসমন্দারা পেলেও, সাধারণ ভাবে এই সমাজ নানা ভাবে পীড়িত এবং অত্যাচারিত। এক দিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এই মানুষেরাই মূলত আক্রান্ত, কারণ এদের বসবাস রাস্তার ধারের ঝুপড়িতে। আবার মুসলমান সমাজের উপরের দিকের ১০-১৫ শতাংশ আশরাফ সুযোগ-সুবিধামতো তাদের ব্যবহার করে। এই সামাজিক-অর্থনৈতিক ‘কন্ট্রাডিকশন’ বা বৈপরীত্যই রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন নরেন্দ্র মোদী।

তবে, মোদী গত কয়েক মাস আগে বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন, এমন নয়। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার এক বছর আগেই, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২০১৩ সালে উত্তরপ্রদেশের পসমন্দাদের নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেছিলেন। পরের দশ বছরে তিনি বার বার সমাজের একাংশের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রশ্ন ওঠে, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল কেন মুসলমান সমাজের মধ্যে এই শ্রেণিগত বিভাজন চিহ্নিত করে কাজে লাগাতে পারল না, তা নিয়ে।

বিজেপি কেন পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইছে, তার নানান কারণ রয়েছে। প্রথমত, দৈনন্দিন রাজনীতির দিক থেকে যখন খুব একটা চাপ নেই তখন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবে হিন্দুত্ববাদী আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটাই সবচেয়ে ভাল সময় বলে বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছেন। বিশ কোটি মুসলমানকে এর বাইরে রেখে সেই কাজ করা মুশকিল। হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের অন্যতম তাত্ত্বিক দীনদয়াল উপাধ্যায় ‘ইন্টিগ্রাল হিউম্যানিজ়ম’ বা সমাজের সব অংশের মানুষকে জোড়ার তত্ত্ব দিয়েছিলেন। বলেছেন, সব স্তরের মানুষের একটা মৌলিক অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নতি না হলে আদর্শভিত্তিক রাজনীতি বাধাগ্রস্ত হয়। অর্থাৎ, সার্বিক হিন্দুত্ববাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্কার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে, যদি সমাজের সব অংশের অর্থনৈতিক উন্নতি না হয়। পসমন্দাদের সামনে রেখে সেই জোড়ার কাজটা হয়তো শুরু করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী।

দ্বিতীয় কারণকে তাঁর মতো করে ব্যাখ্যা করলেন পসমন্দাদের বৃহত্তম সংগঠন পসমন্দা মুসলিম মহাজের সভাপতি আলি আনোয়ার। বিষয়টিকে বিজেপির ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি বলে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহার মিলিয়ে ভারতের লোকসভায় এক-পঞ্চমাংশ আসন রয়েছে। দুই রাজ্যেই পসমন্দাদের সংখ্যা খুব বেশি, তাই মুসলমানদের ভোট ভাঙতে নতুন সংখ্যালঘু রাজনীতি শুরু হয়েছে। দশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে ২০২৪ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোট বিজেপির বিরুদ্ধে যাবে। এটা মাথায় রেখেই ভোট ভাঙার চেষ্টা শুরু হয়েছে বলে মনে করেন আনোয়ার।

ভারতে শ’খানেক লোকসভা আসনে ২০ শতাংশ বা তার বেশি মুসলমান রয়েছেন। এই যে বিপুল পরিমাণে বিজেপিবিরোধী ভোট, সেটা যাতে কোনও নির্দিষ্ট দলের বাক্সে না গিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাগ হয়, সেটা মাথায় রেখেই পসমন্দা সমাজকে কাছে টানার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এই লক্ষ্যে বিজেপি কিছুটা যে সফল, তার প্রমাণ উত্তরপ্রদেশের সাম্প্রতিক কয়েকটি উপনির্বাচন। এমন আসনে বিজেপি জয় পেয়েছে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা ৫০ শতাংশের উপরে। তবে আনোয়ার এও মনে করেন যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা এমন কিছু করবেন না যাতে ২০২৪-এ বিজেপির লাভ হয়।

“মুসলমানদের বাড়ি, দোকান এবং মাদ্রাসা বুলডোজ়ার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে, তাদের প্রায় নিয়মিতই পেটানো হচ্ছে। চিরাচরিত ব্যবসা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ প্রায় বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত মুসলমান-বিরোধী সামাজিক আন্দোলন তৈরি করা হচ্ছে বা সংখ্যালঘু বিরোধী আইন আনা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই মূলত গরিব অর্থাৎ পসমন্দা, এমনকি বিলকিস বানোই এক জন পসমন্দা। ফলে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য বিজেপি সাংঘাতিক চিন্তিত, এটা বিশ্বাস করা মুশকিল,” বক্তব্য আনোয়ারের।

স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি বিষয়টাকে তাদের মতো করে দেখছে। পসমন্দাদের বিজেপি-পন্থী সংগঠন, রাষ্ট্রবাদী মুসলিম পসমন্দা মাহাজের সভাপতি আতিফ রশিদ একটি তালিকা দিয়ে বললেন গত বছরখানেকের মধ্যে কী ধরনের সরকারি পদ পেয়েছেন পসমন্দারা।

ভারতে সর্বোচ্চ মুসলিম জনসংখ্যার রাজ্য উত্তরপ্রদেশে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রীর মতো ‘হাই-প্রোফাইল’ নিয়োগ থেকে সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার জন্যে কাশ্মীর থেকে পসমন্দা সমাজের সদস্যকে মনোনীত করা হয়েছে। রশিদকেও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের উপ-সভাপতি করা হয়েছিল যা আগে কোনও পসমন্দাকে করা হয়নি। তবে বিজেপি কেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে আশরাফ বা পসমন্দা কাউকেই মনোনয়ন দেয় না, এই প্রশ্ন অবশ্য এড়িয়ে গেলেন রশিদ।

বিজেপির ওবিসি সেলের সভাপতি কে লক্ষ্মণ বলেন পসমন্দাদের জন্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা ‘তাঁদের অন্যতম উদ্দেশ্য’। ভারতের পাঁচ হাজারেরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুর জন্য ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ রয়েছে। বিজেপি উত্তরপ্রদেশের আলিগড়, দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং জামিয়া হামদর্দ-এর মতো শীর্ষ সংখ্যালঘু বিশ্ববিদ্যালয়ে পসমন্দাদের জন্য সংরক্ষণ চায়। এই পরিকল্পনা ২০২৪-এর নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে করা হয়নি বলেও জানালেন লক্ষ্মণ।

তবে বিজেপির একটা বড় সমস্যাও আছে। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শীদের মধ্যে যাকে সম্ভবত সবচেয়ে শ্রদ্ধা করা হয় সেই এম এস গোলওয়ালকর, তাঁর বই বাঞ্চ অব থটস-এ (১৯৬৬) লিখেছেন, “মুসলিম সম্প্রদায় একটি বিপজ্জনক ষড়যন্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত, তারা অস্ত্র জমিয়ে দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতের জন্য নিজেদের সংগঠিত করছে।”

অর্ধশতাব্দী পরে, মুসলমান-বিরোধী এই দর্শন থেকে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বা নেতাকর্মীদের সরে আসার কোনও আনুষ্ঠানিক প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। নেতাকর্মীদের উপরেই যে-হেতু নির্বাচনে জেতা-হারা নির্ভর করে তাই তাদের অসন্তুষ্ট করে পসমন্দাদের কাছে টানতে পারবে না বিজেপি। ফলে, মুসলমান বিরোধিতা এবং পসমন্দাদের কাছে টানার কাজ একই সঙ্গে চলবে বলে মনে করছেন এই বিষয়ের গবেষকরা।

এই অবস্থায়, নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপির ডাকে শেষ পর্যন্ত উত্তর ভারতের পিছিয়ে পড়া মুসলমান কত দূর সাড়া দেবে তা বলবে ২০২৪-এর নির্বাচন।

(ঋণ স্বীকার: অধ্যাপক খালিদ আনিস আনসারি, আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়, বেঙ্গালুরু। অধ্যাপক মহম্মদ রিয়াজ়, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন