Education Sector

চরিত্র বদলেছে বলেই বিপন্ন

ত্রিশের দশকে আইএসআই বা ষাটের দশকে কোর গঠনের সময় মূল উদ্দেশ্য ছিল একটা কেন্দ্র তৈরি করা, যাকে আগামী দিনের গবেষকরা নিজের খেয়ালখুশি মতো জ্ঞানচর্চা করার স্থায়ী বাসস্থান হিসাবে ব্যবহার করবে।

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৪৭
Share:

গত শতকের দ্বিতীয় ভাগে আধুনিক অর্থনীতির খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন যাঁরা, বেলজিয়ান অর্থশাস্ত্রী জ্যাক দ্রেজ়— হ্যাঁ, তিনি জঁ দ্রেজ়-এর পিতা। ১৯৬৬ সালে জ্যাক মাত্র তিন-চার জন গবেষক বন্ধুকে নিয়ে ছোট এক গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন— ‘সেন্টার ফর অপারেশনস রিসার্চ অ্যান্ড ইকনোমেট্রিক্স’, সংক্ষেপে ‘কোর’। আজও গাণিতিক অর্থশাস্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে এটি দুনিয়ার অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান।

জ্যাক দ্রেজ়-এর ‘কোর’ এবং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আইএসআই-এর ইতিহাস, গঠন, কার্যপদ্ধতি ইত্যাদিতে অজস্র মিল। তবে, পৃথিবীতে আইএসআই বা কোর-এর মতো কেন্দ্র এই দু’টি মাত্র তো নয়; বিভিন্ন দেশেই নানা ধরনের জ্ঞানচর্চার নানাবিধ গবেষণাকেন্দ্র আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির বিবিধতার মধ্যেও একটা মস্ত মিল— সকলেরই দুশ্চিন্তা, কী করে নিজেদের অস্তিত্বটা বজায় রাখব? টিকে থাকতে গেলে কী কী করতে পারব, অথবা পারব না? প্রতিষ্ঠান চালানোর টাকাটা আসবে কোথা থেকে; আর সেই টাকা পেতে কী করণীয়?

ত্রিশের দশকে আইএসআই বা ষাটের দশকে কোর গঠনের সময় মূল উদ্দেশ্য ছিল একটা কেন্দ্র তৈরি করা, যাকে আগামী দিনের গবেষকরা নিজের খেয়ালখুশি মতো জ্ঞানচর্চা করার স্থায়ী বাসস্থান হিসাবে ব্যবহার করবে। হলও তাই। পরের কয়েক দশকে সেই ঘরের বাসিন্দারা শুধু বিমূর্ত গবেষণার খেয়ালেই মেতে চললেন। আইএসআই এবং কোর, গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে দুই প্রতিষ্ঠানেই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।উপলব্ধি করেছি, এই দুই জায়গাতেই অঙ্ক কষার আবেগ, কবিতা লেখা বা গান গাইবার মতোই বিশুদ্ধ। কেউ সেই কবিতা পড়ল কি না, গান শুনল কি না, অঙ্কটা জাগতিক কোনও কাজে ব্যবহার হল কি না, তা তাঁরা জানতেও চান না। তাঁদের কাজ বাজারে বিক্রি হবে কি না, হলেও তার মূল্য কত হবে, এ ভাবনা ছিল না।

তবে, জ্যাক বা প্রশান্তচন্দ্র জানতেন যে, নিজের জন্য না হলেও আগামী প্রজন্মের কথা ভেবেই জ্ঞানের মূল্যায়ন দরকার; গবেষণাকেন্দ্র গড়তে, ভবিষ্যতে চালাতে তো হবে, অতএব, অর্থাগম আবশ্যিক। তাঁরা তাই প্রতিষ্ঠানকে সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন। আমাদের সৌভাগ্য, তাঁরা মুক্ত বাজারে তত্ত্ব বেচেননি। ষাটের দশকে জ্যাক দ্রেজ়-এর খ্যাতি তখন ইউরোপে, আমেরিকায় গগনচুম্বী; কোর চালানোর জন্য তাই প্রথম পাঁচ বছর টাকা দিয়েছিল আমেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশন। তার পর বেলজিয়ান সরকার দায়িত্ব নেয়। ব্রাসেলসের দক্ষিণে গড়ে ওঠা লুভ্যাঁ-লা-নভ শহরের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির অন্তর্ভুক্ত হয় এই কেন্দ্র। কোর-কে সক্রিয় রাখতে দ্রেজ় আজীবন দেশের জন্য যাবতীয় ‘প্রোজেক্ট’-এর কাজ করেছেন। মহলানবিশের গবেষণাকেন্দ্রকেও সরকারি অনুদান দিতে নেহরু তাঁর দলের সাংসদদের সমর্থন পেয়েছিলেন; পরিবর্তে প্রশান্তচন্দ্র সদ্য-স্বাধীন দেশকে উপহার দিয়েছেন পঞ্চবার্ষিকী যোজনা। কিন্তু, বেলজিয়াম বা ভারতের সরকার কোর বা আইএসআই কী ভাবে চালানো হবে, তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি।

ফলে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ছিল অবাধ স্বাধীনতা। চার-পাঁচ দশক আগে, আইএসআই-এ প্রতি বছর কিছু ছাত্রছাত্রী ভর্তি হত। সবাই বৃত্তি পেতেন; ক্যান্টিনে নামমাত্র মূল্যে খাবার মিলত। জ্ঞানবিজ্ঞান আদানপ্রদানের এক আশ্চর্য পরিবেশ; অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নিয়মের বাঁধন নেই— শিক্ষকরা যা পড়াবেন, তা-ই সিলেবাস। কোর-এ পৌঁছেও দেখেছিলাম, ছবিটা ঠিক একই রকম। মনে আছে, প্রথম আলাপে অধ্যাপক দ্রেজ় বলেছিলেন, পাঠক্রমগুলোর নাম হওয়া উচিত সংশ্লিষ্ট অধ্যাপকের নামে— তাঁরা যা পড়াবেন, যা পড়াতে চান, তা-ই সিলেবাস।

আজ কী এমন ঘটল, যার ফলে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট অ্যাক্ট, ২০২৫ বানিয়ে আইএসআই-তে ‘বডি কর্পোরেট’ গঠনের প্রস্তাব দিতে হল? সত্যিটা রাজনীতিতে নয়, আমাদের এই সমাজেই লুকিয়ে আছে। চল্লিশ বছর আগে মা-বাবারা কেরিয়ার গড়ার জন্য সন্তানকে কবি বা গণিতজ্ঞ হওয়ার কথা বলতেন না— আজও কেউ সন্তানকে কবি হতে বলেন না, কিন্তু আইএসআই-এর মতো প্রতিষ্ঠানে গণিতের পাঠ নেওয়া এখন অতি উজ্জ্বল কেরিয়ার-সম্ভাবনা। উদার অর্থনীতির ভারতে গোটা দেশই কর্পোরেট-বডি হতে চেয়েছে। আর তাই, মেধার খোঁজে সেই কর্পোরেট ভারত আইএসআই-এ ঢুকে মহলানবিশের সাজানো বাগান তছনছ করে দিল। মধ্যবিত্ত বাবা-মায়েরা জানলেন, আইএসআই-এ পড়লে মোটা মাইনের চাকরি মেলে। যেমন, ধ্রুপদী সঙ্গীত শিখলে বলিউডের নায়কের প্লে-ব্যাক করা যায়। অতএব, আইএসআই-এ ভর্তি হওয়ার তোড়জোর শুরু হল— প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশের জন্য কোচিং সেন্টার খুলল। বাবা-মা ছেলের অঙ্ক ভাল লাগে কি না জানতে চান না, ‘সাকসেস-প্রবাবিলিটি’ কত, শুনতে চান।

এই সিঁড়িভাঙা অঙ্কের পরের ধাপটা আরও সরল। উৎকর্ষ থেকে জন্মায় ক্ষমতা। আর সেই ক্ষমতা দখলের জন্য চলে রাজনীতির লড়াই। কমলাকান্তের যুক্তি এখানে খাটে না— টাকা দিয়েছেন যিনি, গরু তাঁরই; দুগ্ধপোষ্যের নয়। গবেষণাকেন্দ্রে রাজনৈতিক দলের নিজস্ব মতাদর্শ প্রত্যক্ষ হয় প্রতি পদে। নতুন অ্যাক্ট তারই প্রতিফলন মাত্র। অ্যাক্ট মেনে চললে দ্রেজ়-এর মতো শিক্ষকরা আর নিজের কোর্স নিজের মতো করে পড়াতে পারবেন না।

আজ আইএসআই বা রাজ্যের বা কেন্দ্রের অর্থে পুষ্ট কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাকেন্দ্রের অবনমনের জন্য বিশেষ কোনও দলকে দোষারোপ করা অর্থহীন। ক্ষমতাসীন দল নিজের মতো করেই সরকারি সংস্থা চালাবে। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ থাকলে হয়তো আজ আমাদের কোদালকে কোদাল বলে এই সত্যটি স্বীকার করার পরামর্শই দিতেন।

অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন