রাজনীতির উলট-পুরাণ
Jai Shree Ram

আজ ‘জয় সিয়ারাম’ আর ‘জয় শ্রীরাম’ পরস্পরের বিরোধী

জওহরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, রামচন্দ্র ‘সিয়ারাম’ ধ্বনিকে বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের এককাট্টা করতে ব্যবহার করেছিলেন।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:২৯
Share:

জয় সিয়ারাম’! ঠিক একশো বছর আগেরই কথা। অযোধ্যার মাটি থেকে তখনও ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ওঠেনি। রামচন্দ্র ছিলেন। রামায়ণের নয়। বাবা রামচন্দ্র। আসল নাম শ্রীধর বলবন্ত জোধপুরকর। পশ্চিম ভারত থেকে অযোধ্যায় গিয়ে ডেরা বাঁধার আগে কয়েক বছর ফিজিতে বাঁধা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তার পর পালিয়ে আসেন।

Advertisement

অওধের গ্রামের গরিব চাষিরা তখন জমিদার, মহাজন, পুলিশের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন। চাষের জন্য জমিদারের বেআইনি চাহিদা মেটাতে মহাজনের থেকে চড়া সুদে ধার করতে হয়। তার পর মহাজনের সুদ, জমিদারের পাওনার কোনওটাই মেটাতে না পেরে ঘটিবাটি সমেত উচ্ছেদ হতে হয়। ব্রিটিশ সরকারের পুলিশের কাছে জোটে মারধর, গালমন্দ।

বাবা রামচন্দ্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে এই গরিব চাষিদের তুলসীদাসের শ্রীরামচরিতমানস পড়ে শোনান। তার ফাঁকে গ্রামের মানুষদের এককাট্টা হতে বলেন। এ গ্রামের সঙ্গে ও গ্রামের মানুষের কথা বলিয়ে দিতে সভা ডাকেন। সভা থেকে মহাপঞ্চায়েত। তৈরি হয় কিসান সভা। ‘সালাম’-এর বদলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে একে অপরকে ‘জয় সিয়ারাম’ বলে অভিবাদন জানাতে শেখান। জমিদারের লেঠেল বাহিনী বা পুলিশ এলেও সেই ‘জয় সিয়ারাম’-ই সবাইকে জড়ো করার সঙ্কেত হয়ে ওঠে।

Advertisement

অওধের মানুষের বিশ্বাস ছিল, ফৈজাবাদ, রায়বরেলী ও প্রতাপগড় গ্রাম নিয়েই ছিল রামায়ণের অযোধ্যা। বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে ১৯২০ থেকে ১৯২১-এ এই তিন গ্রামেই কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। জওহরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, রামচন্দ্র ‘সিয়ারাম’ ধ্বনিকে বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের এককাট্টা করতে ব্যবহার করেছিলেন। তা থেকেই কৃষকদের উত্থান।

ঠিক একশো বছর পরে, ২০২১-এর ভারতে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ও কৃষক আন্দোলন যেন একে অপরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। দিল্লির সীমানায় কৃষকদের আন্দোলনে জাত-ধর্মের বিভাজন মুছে যাচ্ছে। তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে তিন মাসের আন্দোলনে কে জাঠ, কে মুসলমান, তা ভুলে গিয়ে কৃষক পরিচয়টাই ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। জাঠদের কিসান মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চে আবার মুসলিম কৃষক নেতারা হাজির হচ্ছেন।

এক সময় কৃষক নেতা চৌধরি চরণ সিংহ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে মুসলিম, আহির বা যাদব, জাঠ, গুজ্জর ও রাজপুতদের জাত-ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন মুছে দিয়ে শুধুমাত্র কৃষক হিসেবে এককাট্টা করেছিলেন। কিন্তু আশির দশকে রামজন্মভূমি আন্দোলনে কৃষক পরিচিতি মুছে গিয়ে বড় হয়ে উঠল হিন্দু পরিচিতি। অওধের মানুষকে বাবা রামচন্দ্রের শেখানো ‘জয় সিয়ারাম’ অভিবাদন ক্রমশ ফিকে হয়ে গেল। তার জায়গা নিল ‘জয় শ্রীরাম’। অযোধ্যার ইতিহাস বলে, রামজন্মভূমি আন্দোলন যখন জোরদার হচ্ছে, তখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলের নেতারা দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বলতেন, ‘রাম রাম ছোড়ো, জয় শ্রীরাম বোলো’। জয় সিয়ারাম-এ আগে সীতা, তার পরে রামের নাম আসে। তাতে যেন প্রজাদরদি রাজা, স্ত্রী-র প্রতি অনুরক্ত রামের কোমল চরিত্র ফুটে ওঠে। জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে তার বদলে বেশ নির্ভীক, যুদ্ধং দেহী ভাব। রামজন্মভূমি আন্দোলনের ঢেউয়ে ‘রাম রাম’, ‘জয় রাম জি কি’-র মিঠে অভিবাদন বা ‘সিয়াবর রামচন্দ্র কি’-র জয়ধ্বনির মতোই পিছনের সারিতে চলে গেল রাম-সীতার যুগলমূর্তি ছবি। রাম দেখা দিলেন তির-ধনুকে সজ্জিত যোদ্ধার বেশে।

এই জয় শ্রীরামের স্লোগানে ভর করে ১৯৮৪-তে লোকসভায় দুই সাংসদের দল বিজেপি ১৯৮৯-এ ৮৫ জন সাংসদকে জিতিয়ে এনেছিল। ১৯৯১-এ বিজেপির সাংসদ সংখ্যা বেড়ে হল ১২০। তার পর ১৯৯৬-তে ১৬১টি আসনে জিতে প্রথম বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে উঠে এল বিজেপি।

২০১৪-র লোকসভা ভোটের প্রচারে নরেন্দ্র মোদীর মুখে বিশেষ জয় শ্রীরাম ধ্বনি শোনা যায়নি। এমনকি ২০১৯-এর মে মাসে ফৈজাবাদে জনসভা পর্যন্ত তিনি অযোধ্যামুখো হননি। সেই জনসভাতেও নরেন্দ্র মোদীর মুখে রামমন্দিরের বদলে ছিল সন্ত্রাসবাদ দমনের কথা। ২০২০-র অগস্টে প্রধানমন্ত্রী যখন অযোধ্যার রামমন্দিরের ভূমিপুজোয় গেলেন, তখন দেখা গেল, মোদীর মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ নয়, সেই ‘জয় সিয়ারাম’ ধ্বনি। রামের সঙ্গেই জানকীকে স্মরণ করে তিনি বললেন, ‘সিয়াবর রামচন্দ্র কি জয়... জয় সিয়ারাম’।

জল্পনা হয়েছিল, রামমন্দির নির্মাণ শুরুতে রামজন্মভূমি আন্দোলন পরিণতি পাওয়ায় তবে কি রামের জয়ধ্বনিকেও পুরনো রূপে ফেরাতে চাইলেন মোদী? কিন্তু দেখা গেল, তা নয়। অযোধ্যায় ‘জয় সিয়ারাম’ বললেও বিহারের ভোটের প্রচারে গিয়েই নরেন্দ্র মোদী প্রশ্ন তুললেন, বিরোধীদের ‘জয় শ্রীরাম’, ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলতে আপত্তি কেন? গত ২৩ জানুয়ারি কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সামনেই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ওঠায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরক্ত হয়েছিলেন। বাংলায় প্রচারে গিয়ে অমিত শাহ বললেন, ভোট শেষ হতে হতে মমতাদিদিও ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে শুরু করবেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন, বিধানসভা ভোট শেষ হওয়ার আগেই তিনি বিজেপিকে ‘জয় সিয়ারাম’ বলিয়ে ছাড়বেন।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের কথা শুনে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, জয় শ্রীরাম-এ রাগ করার কিছু নেই। এ তো পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় করতেও বলা হয়। ‘জয় শ্রীরাম’ কোনও রাজনৈতিক স্লোগান নয়।

কথাটা ঠিক নয়। সত্যিই শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্লোগানে আর জয় শ্রীরাম আটকে নেই। গত কয়েক বছরে দেখা দিয়েছে, হরিয়ানা থেকে ঝাড়খণ্ডে গোরক্ষক বাহিনীর হামলার সময় মারমুখী জনতা আক্রমণের শিকার মুসলিম সমাজের মানুষটিকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করছে। ২০১৯-এ দ্বিতীয় বার ভোটে জিতে আসার পরে নরেন্দ্র মোদী সংসদের সেন্ট্রাল হলে সংবিধানে মাথা ঠেকিয়ে বলেছিলেন, তিনি এ বার সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনের নীতি নেবেন। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর সঙ্গে ‘সবকা বিশ্বাস’। কিন্তু লোকসভায় নতুন সাংসদদের শপথগ্রহণের সময় দেখা গিয়েছিল, হায়দরাবাদের আসাদুদ্দিন ওয়েইসি থেকে রামপুরের আজম খানরা শপথ নিতে উঠলে বিজেপির তিনশো তিন জন সাংসদ ‘জয় শ্রীরাম’ বলে গগনভেদী জয়ধ্বনি তুললেন। বাদ যাননি তৃণমূলের সাংসদরাও।

আশির দশকে রামজন্মভূমি আন্দোলনের সময় যে জয় শ্রীরাম ধ্বনি বিজেপির রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠেছিল, মোদী সরকারের আমলে গোরক্ষক বাহিনীর দাপটে সেটাই হয়ে উঠল হেনস্থার হাতিয়ার। এখন আবার তা পশ্চিমবঙ্গের ভোটে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে বিজেপির রাজনৈতিক অস্ত্র। রামজন্মভূমি আন্দোলন পরিণতি পেলেও তাই ‘জয় শ্রীরাম’-এর রাজনৈতিক প্রয়োজন ফুরোলো না।

অযোধ্যায় রামমন্দিরের নির্মাণের উদ্দীপনাতে, মন্দিরের জন্য অর্থ সংগ্রহ অভিযানে ফের উত্তরপ্রদেশ-সহ গোটা দেশে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি উঠছে। এই উদ্দীপনায় ভর করে ২০২২-এর বিধানসভা ভোটে জিতে ফের যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসতে চাইছেন। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের ফলে তৈরি নতুন সামাজিক সমীকরণ তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। ধর্মের বিভাজন ভুলে কিসান মহাপঞ্চায়েতের এক মঞ্চে আসছেন জাঠ-মুসলিম সমাজের নেতারা। জয় শ্রীরাম ধ্বনি তাকে আড়াল করতে পারছে না।

২০১৩-য় মুজফ্ফরনগরের জাঠ বনাম মুসলিম সংঘর্ষের পরে গত সাত-আট বছর ধরেই পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ ও মুসলিমরা দুই ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে। ২০১৭-য় উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোট ও ২০১৯-এর লোকসভা— এর পুরো ফয়দা কুড়িয়েছিল বিজেপি। অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির রাজত্বে মুসলিমদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে বিজেপি পুরো হিন্দু জাঠ ও উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোট নিজেদের ঝুলিতে টেনেছিল। অজিত সিংহের মতো জাঠ নেতাও হেরে যান।

দিল্লির সীমানায় গত তিন মাসের কৃষক আন্দোলন বিজেপির এই সমীকরণেই ধাক্কা দিয়েছে। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের কিসান মহাপঞ্চায়েতে জাঠদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মেলাচ্ছেন মুসলিম, গুজ্জর, সাইনি-র মতো অ-জাঠ সম্প্রদায়। জাত-ধর্মের পরিচয় ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে কৃষকের শ্রেণি পরিচয়। যেন আড়াল থেকে বাবা রামচন্দ্র ফের ‘জয় সিয়ারাম’ বলে সবাইকে এককাট্টা করছেন। ভারতের রাজনীতির গতিপথ বদলে দেওয়া ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি ফের যেন নিজেই দিক পাল্টে বিপরীতমুখী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন