bengaluru

বেঙ্গালুরুর শ্রমজীবী বাঙালি

এই মানুষগুলোর জন্য কর্নাটক সরকারের তরফে সামাজিক সুরক্ষার বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেই।

Advertisement

অভিরূপ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২১ ০৯:০৪
Share:

বেঙ্গালুরু, ভারতের সিলিকন ভ্যালি। মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে উচ্চশিক্ষা, চাকরি, বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি দেওয়া শহরের নাম। কিন্তু আরও এক শ্রেণির বাঙালি দিন কাটান বেঙ্গালুরুতে। লালচে ধুলো আর খয়েরি কাদা পেরিয়ে টিন বা ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া তাঁদের সারি সারি ঘর; মাঝে কয়েকটা শৌচালয় থাকলেও স্নানের কোনও ঘর নেই, এক টুকরো পর্দার আড়াল। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, সুন্দরবনের গ্রাম থেকে তাঁরা পৌঁছন হেব্বল, থুবরাহাল্লি, কুডলু গেট, রামমূর্তিনগরের বস্তিতে। অনেকের সঙ্গে সন্তানরাও থাকে। তারা বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেছে কেউ প্রাইমারি, কেউ আবার সপ্তম-অষ্টম শ্রেণি অবধি, কিন্তু নতুন শহরের নতুন ভাষার স্কুলে আর ভর্তি হওয়া হয় না ওদের। বাবা-মা মিলে মাসে হয়তো মোট উপার্জন হয় ১৫ হাজার টাকা, যার মধ্যে বাড়িভাড়া জল বিদ্যুৎ মিলিয়ে হাজার পাঁচেক টাকা চলে যায়। বাকিটা দিয়ে সংসার চলে কোনও মতে, তার থেকে আর সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর টাকা খরচ কোথা থেকে আসবে? শিশু-কিশোররা দিন গোনে, কবে অসংগঠিত শ্রমের বাজারে ওদের জায়গা হবে। পুরুষরা বেশির ভাগ মাঝরাতে বেরিয়ে যান, শহরের আবর্জনা জোগাড় করে বিক্রি করেন কারবারির কাছে। অফিসে ঝাড়ামোছা, অ্যাপ-ভিত্তিক ডেলিভারি, বা মিস্ত্রির কাজও করেন কেউ কেউ। মেয়েরা অধিকাংশই বহুতলের গৃহশ্রমিক। বেঙ্গালুরু-নিবাসী এক লক্ষেরও বেশি এমন বাঙালি মহিলা-পুরুষদের পরিচয়, ‘পরিযায়ী শ্রমিক’।

Advertisement

এই মানুষগুলোর জন্য কর্নাটক সরকারের তরফে সামাজিক সুরক্ষার বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেই। গৃহশ্রমিক পম্পা বললেন, “যত ক্ষণ কাজ করতে পারছি, তত ক্ষণ পেট চলছে। শরীর খারাপ হয়ে কাজ বন্ধ করলে কেউ ঘুরেও তাকাবে না। কাছের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সাধ্য নেই আমাদের। আর এই শহরের বেশি কিছু চিনিও না, দূরে সরকারি হাসপাতাল কোথায় আছে, কোন বাস যায় তা জানি না।” নামমাত্র যা কিছু সরকারি প্রকল্প আছে, সেগুলোও পদ্ধতির বেড়াজাল আর ভাষাগত ব্যবধান পেরিয়ে যাদের দরকার তাদের কাছে পৌঁছয় না। ২০০৭ সালে স্থাপিত হয় কর্নাটক নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ বোর্ড, কিন্তু এই প্রকল্পের উপযোগী পরিযায়ী শ্রমিকদের দুই শতাংশেরও কম এতে নথিভুক্ত হতে পেরেছেন। কারণ, সরকার শ্রমিকদের কাছে এই প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার তেমন চেষ্টা করেনি। নির্মাতাদের থেকে ১% হারে সেস নিয়ে এই বোর্ডের তহবিল দাঁড়িয়েছে ৫০০০ কোটি টাকায়, কিন্তু তার ১০ শতাংশও কল্যাণমূলক প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়নি।

২০০৯ সালে স্থাপিত হয় কর্নাটক রাজ্য অসংগঠিত শ্রমিক সামাজিক সুরক্ষা পর্ষদ। কিন্তু রাজ্যের মোট অসংগঠিত শ্রমিকের ১০ শতাংশকেও পর্ষদে নথিভুক্ত করা যায়নি। পাশের রাজ্য কেরলে পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্পের আওতায় ভিন্‌রাজ্যের শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্য, দুর্ঘটনা বিমা ও জীবন বিমা, প্রসূতি ভাতা, শিশুদের শিক্ষা ভাতা, বেকারত্ব ভাতা প্রভৃতির ব্যবস্থা আছে। তুলনায় কর্নাটক সরকার নিষ্ক্রিয়।

Advertisement

বেঙ্গালুরু-সহ দেশের বিভিন্ন শহরে যাঁরা বাইরের রাজ্য থেকে কাজ করতে আসেন, তাঁদের জীবনযাত্রা উন্নয়নের জন্য কয়েকটি সংগঠন কাজ করে। তেমনই একটি হল পরিযায়ী শ্রমিক সংহতি নেটওয়ার্ক। সংস্থার সদস্য বিক্রম জানালেন, দ্বিতীয় দফার লকডাউনে কর্নাটক সরকার প্রথমে স্থানীয় অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য ২০০০ টাকার অনুদান ঘোষণা করে। পরে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও শ্রমিক ইউনিয়নের চাপে পরিযায়ী শ্রমিকদেরও এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। কিন্তু এই সুবিধা পাওয়ার জন্য পরিযায়ী শ্রমিকদের অনলাইন ফর্ম ভর্তি করতে হয়। অধিকাংশ শ্রমিকই সে বিষয়ে সড়গড় নন। এই নিয়ে কর্নাটক হাই কোর্টও রাজ্য সরকারকে ভর্ৎসনা করেছে।

ওই সংগঠন থেকেই পরিযায়ী শিশুদের জন্য কয়েকটি স্কুল চালানো হয়। শিক্ষক দীপের কথায়, “বাংলার গ্রাম থেকে বেঙ্গালুরুতে এসে শিশুদের স্থানীয় স্কুলে সরাসরি ভর্তি হওয়ার প্রধান অন্তরায় ভাষা। অথচ, কেরলের এর্নাকুলাম জেলায় ‘রোশনি’ প্রকল্পের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিক শিশুদের স্থানীয় ভাষা শেখানো হয়।” এরই সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা দরকার, যাতে পরিযায়ীরা স্থানীয়দের সঙ্গে সামাজিক ভাবে মেলামেশা করতে পারেন।

আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী নীতি সূচক ‘ইম্পেক্স’-এর ২০১৯ সালের রিপোর্টে কর্নাটক পেয়েছে মাত্র ৩২, যা জাতীয় গড় ৩৭-এর চেয়েও কম। কোনও রাজ্যের সরকার পরিযায়ীদের প্রতি কতটা মনোযোগী, এ হল তার পরিমাপ। কেরল এই সূচকের শীর্ষে। কর্নাটকের সরকার ভিন্‌রাজ্যের শ্রমিকদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান নিয়ে কতটা সদর্থক পদক্ষেপ করে, সে দিকেই তাকিয়ে পম্পার মতো মেয়েরা। লক্ষাধিক বাঙালি শ্রমিকের সুস্থ, সক্ষম জীবনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সরকারেরও কি কিছু করার নেই?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন