Madhyamik student

না চাইতে যদি হাতে এসে পড়ে

আধুনিক ভোগবাদের প্রবল জোয়ারে অবশ্য বাহুল্যবর্জিত সেই রাবীন্দ্রিক শৈশব অনেক কাল আগেই ভেসে গেছে। এই প্রজন্মের শিশুরা এখন না চাইতেই অনেক কিছু পায়।

Advertisement

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ০৭:১২
Share:

বয়স দশের কোঠা পার হইবার পূর্বে কোনোদিন কোনো কারণেই মোজা পরি নাই। শীতের দিনে একটা সাদা জামার উপরে আর-একটা সাদা জামাই যথেষ্ট ছিল... আমাদের চটিজুতা একজোড়া থাকিত, কিন্তু পা দুটা যেখানে থাকিত সেখানে নহে।” জীবনস্মৃতি গ্রন্থে নিজের শৈশবের অনাড়ম্বর দিনগুলোর কথা লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। ধন মান বিদ্যা সংস্কৃতিচেতনায় সমৃদ্ধ পরিবারে জন্ম, অথচ পারিবারিক বৈভবের স্পর্শরহিত অতি সাধারণ বাল্য-যাপন নিয়ে তাঁকে আক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। বরং ওই বয়সেই অকিঞ্চিৎকর উপকরণের মধ্যে আনন্দের রসদ খুঁজে নেওয়ার যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, জীবনভর তাকে লালন করেছেন সযত্নে।

Advertisement

আধুনিক ভোগবাদের প্রবল জোয়ারে অবশ্য বাহুল্যবর্জিত সেই রাবীন্দ্রিক শৈশব অনেক কাল আগেই ভেসে গেছে। এই প্রজন্মের শিশুরা এখন না চাইতেই অনেক কিছু পায়। শখ বা চাহিদা যত অযৌক্তিক বা অপ্রয়োজনীয় হোক, তাকে প্রশ্রয় দেওয়াটাকেই কিছু অভিভাবক সন্তানের প্রতি ভালবাসা প্রকাশের পরাকাষ্ঠা বিবেচনা করেন। কেউ আবার নিজের শৈশবের অপ্রাপ্তির কথা মনে রেখে সাধ্যের বাইরে গিয়েও সন্তানের জীবন প্রাচুর্যে ভরিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না। ফলে অভীষ্ট পূরণ বা কাঙ্ক্ষিত কিছু পাওয়ার জন্য যে পরিশ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়, শিশুমনে এই বোধ বিকশিত হওয়ার সুযোগ ক্রমে সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুরা বিনা আয়াসে সব কিছু পেতে এমন অভ্যস্ত হয়ে উঠছে যে, এই অযাচিত প্রাপ্তিকে অধিকার ভাবতে শুরু করছে।

তবে লক্ষণীয়, শিশুকে অপ্রয়োজনীয় উপহারে তুষ্ট করার এই প্রবণতা স্রেফ পারিবারিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বহু ক্ষেত্রে অনভিপ্রেত ‘দরদ’ দেখানোর বিষয়ে রাষ্ট্র যেন পরিবারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। তার অভিঘাতে একটা গোটা প্রজন্ম যে ক্রমশ শ্রমবিমুখ, নৈতিকতাবর্জিত, আত্মসম্মানবোধশূন্য হতে চলেছে, সম্প্রতি কিছু ঘটনায় ইঙ্গিত তেমনই।

Advertisement

এ বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর অনুপস্থিতি দেখা গিয়েছিল। অনুমান করতে অসুবিধে নেই, কোভিডকালে দীর্ঘ অনভ্যাসে বহু ছাত্রছাত্রী শিক্ষাঙ্গন থেকে বিদায় নিয়েছে। যারা পরীক্ষায় বসেছিল তাদের একটা বড় অংশের ফল এত খারাপ হয়েছে যে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের চূড়ান্ত পরীক্ষায় বসতে দিতে নারাজ। গত বছরেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে ফেল করা কিছু ছাত্রছাত্রীকে দেখা গিয়েছিল পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবি নিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে স্কুলের গেটে ও রাস্তায় আন্দোলন করতে। শামিল হয়েছিলেন কিছু অভিভাবকও।

এ বার টেস্টে উত্তীর্ণ ‘করিয়ে দেওয়া’র দাবিটির নেপথ্য যুক্তি কিছুটা ভিন্ন। ক’দিন আগে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এক সরকারি অনুষ্ঠানে অন্যান্য বোর্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য রাজ্যের বোর্ড ও কাউন্সিলের পরীক্ষার্থীদের অকৃপণ ভাবে নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল। সেই সরকারি ভাষ্যকেই হাতিয়ার করে পথে নেমেছে এ বারের টেস্টে অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকেরা।

ভারতের মতো দেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি-সহ জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা অবশ্যই কাম্য। পাশাপাশি কত দিন এবং কত দূর পর্যন্ত তা সম্প্রসারিত হওয়া বিধেয়, সে সম্পর্কেও একটা সীমারেখা থাকা প্রয়োজন। দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে ও ধরে রাখতে বিনামূল্যে বইখাতা, ব্যাগ, জুতো, ইউনিফর্ম-সহ শিক্ষার নানা উপকরণ প্রদান যে অপরিহার্য, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। একই ভাবে ‘কন্যাশ্রী’-র টাকা বা ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল ওই শিক্ষার্থীদের কাছে অসীম গুরুত্বের, নিশ্চয়ই। কিন্তু ভেবে দেখার দরকার, সব পরিবারের শিশুদের এগুলির সত্যিকারের প্রয়োজন রয়েছে কি না। একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে, যাদের সামর্থ্য আছে, সেই সব পরিবারের পড়ুয়াদের কাছে এগুলো নিতান্তই মূল্যহীন, হেলাফেলার সামগ্রী। পড়াশোনার সুবিধার্থে ট্যাব কিনতে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের দশ হাজার করে টাকা দেওয়া হলেও প্রাপকদের একাংশ টেস্ট পরীক্ষাতেই বসেনি। কোভিডকালে এ প্রকল্প যখন শুরু হয়েছিল, তখনও কোনও কোনও প্রাপকের বিরুদ্ধে ট্যাব না কিনে সেই টাকা শিক্ষা-বহির্ভূত খাতে খরচ করার অভিযোগ উঠেছিল।

এ ধরনের অযাচিত উপঢৌকনে শিক্ষার মানের কতটা উন্নতি ঘটেছে তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ থাকলেও, বার বার অপ্রয়োজনীয় ও অনায়াস প্রাপ্তির ফলে এক শ্রেণির ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকরা হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন যে, ট্যাব বা সাইকেলের মতোই পরীক্ষায় ঢালাও নম্বর পাইয়ে দেওয়াটাও রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। আর যদি সেটি রাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি হয়, তা হলে পরীক্ষা মানে তো নিছকই নিয়মরক্ষা! শিক্ষক-শিক্ষিকারাই বা নম্বর দিতে কার্পণ্য করবেন কোন অধিকারে?

একটা জাতিকে ধ্বংস করার পক্ষে ছাত্রছাত্রীদের (অভিভাবকদেরও বটে) অভিযোজিত এই মানসিকতার চাইতে শক্তিশালী আয়ুধ বুঝি আজও আবিষ্কৃত হয়নি— প্রকৃত শিক্ষানুরাগীদের এই ভাবনাকে তাই অমূলক বলা যাবে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন