Homosexuality

আইন পাল্টেছে, পরিস্থিতি নয়

অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাশে থাকার চেষ্টা করেন। কিছু অসরকারি সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

Advertisement

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২২ ০৪:৫০
Share:

এক বহুজাতিক গবেষণা সংস্থা ২০২১ সালে তাদের এক সমীক্ষায় জানিয়েছিল, ভারতে তিন শতাংশ মানুষ সমকামী। অবশ্য এই পরিসংখ্যান সেই মানুষদের উপরেই ভিত্তি করে তৈরি, যাঁরা নিজেদের যৌন-পরিচয় সকলের সামনে প্রকাশ করেছেন। এর বাইরেও অসংখ্য মানুষ আছেন যাঁরা সমাজের ভয়ে, কুণ্ঠায় নিজেদের সামনে আনতে পারেন না।

Advertisement

২০১৮-র ৬ সেপ্টেম্বর, ভারতীয় সংবিধান ৩৭৭ ধারাকে প্রত্যাহার করে সমকামিতাকে ‘অপরাধ’-এর তকমা থেকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু, ৩৭৭ ধারার প্রত্যাহার সাংবিধানিক ভাবে সমকামী মানুষদের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিলেও দৈনন্দিন অপমান থেকে তাঁদের মুক্তি দেয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই অপমান-তাচ্ছিল্যের প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটে তাঁদের পরিবারের মধ্য থেকেই। সমকামিতা সম্পর্কে সমাজের প্রধান অংশের যে বিরূপ ধারণা, তার সঙ্গে প্রায়ই সমকামী ব্যক্তিদের পরিবারের মনোভাব মিলে যায়। যদি কোনও সমকামী ব্যক্তি নিজের পরিচয়ের কথা পরিবারকে জানান বা নিজের যৌন-অভিমুখ অনুযায়ী আচরণ করেন, তা হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর কপালে জোটে ভয়ঙ্কর তিরস্কার, প্রচণ্ড ঘৃণা। সমকামিতাকে মানসিক বিকৃতি ভেবে তার চিকিৎসাও করানো হয়।

কিছু দিন আগে জানা গিয়েছিল যে, বারাসতের এক তরুণ তাঁর সমকামী সত্তার কথা পরিবারকে জানালে নিজের পরিবার থেকেই খুনের হুমকির সামনে দাঁড়াতে হয় তাঁকে। সেই তরুণের উপর শারীরিক নিপীড়নের পাশাপাশি চলতে থাকে মানসিক অত্যাচারও। তাঁর প্রেমিককেও যথেষ্ট মারধর করা হয়। দেশের অন্য প্রান্তে, গুজরাতে, পুলিশকর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় আলাপ হয় দু’জন মহিলার। পরে তাঁদের মধ্যে প্রেমসম্পর্ক স্থাপন হলে দু’জনের পরিবার তা মেনে নেয় না, তাঁদের ক্রমাগত প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চলে। নিরাপত্তার জন্য তাঁরা আদালতের কাছে যান। দু’টি ঘটনাই ঘটেছে ৩৭৭ ধারা প্রত্যাহারের পরে।

Advertisement

নারী ও পুরুষ— সমাজে এই দুই প্রধান লিঙ্গ-ধারণা একটি প্রতিষ্ঠানের মতো, যে প্রতিষ্ঠান সর্বশক্তিমান। এর বাইরে অন্য কোনও স্বকীয় প্রকাশ, এই দুই শ্রেণির কেউই প্রায়শই মেনে নিতে পারে না। আর তখনই শুরু হয় অত্যাচার। ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে সমকাম সম্পর্কে জানেন না, এমন মানুষ শিক্ষিত-সমাজে নেই বলেই ধরে নেওয়া যায়। তা সত্ত্বেও, কোনও সমকামী মানুষ যখন হেঁটে যান, তার দিকে বেশির ভাগ সময়েই ছুড়ে দেওয়া হয় বিদ্রুপ ও কটাক্ষের হাসি। সামনে ভাল ব্যবহার করলেও, পিছনে তাঁর সম্পর্কে নানা কথা চলতে থাকে। যদি সেই ব্যক্তি সমাজে নিজ গুণে প্রতিষ্ঠিতও হন, তবু তাঁর সেই গুণকে ছাপিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠাকে অবনমিত করা হয় তিনি শুধু এক জন প্রান্তিক মানুষ বলে। ছেলেটি নারীসুলভ, মেয়েটি পুরুষালি— এগুলোই হয়ে দাঁড়ায় আলোচনার বিষয়।

অবশ্য সমাজের এই মনোভাবকে ‘আলোচনা’ না বলে পিতৃতন্ত্রের এক ধরনের শাসন বলা যায়। যে শাসনের সঙ্গে অদৃশ্য সূত্রে যুক্ত হয়ে আছে সেই ভিন্ন স্রোতের মানুষদের যৌন-জীবনের প্রতি এক তীক্ষ্ণ নজর। যাঁরা সমকামী, তাঁদের সম্পর্কে অনেকেই এমন ভেবে নেন যে, তাঁরা সব সময় প্রস্তুত— অপমান, অনাদরের জন্য তো বটেই, যৌন-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যও তাঁদের যে কোনও মুহূর্তে ব্যবহার করা যায়। এর একটা সুবিধা হল, তাঁরা সহজে কাউকে কিছু বলতে সাহস পাবেন না। সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করবেন।

এক সমকামী তরুণ তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। ছেলেটি খুবই নরম স্বভাবের, গ্রামের এক দোকানে কাজ করেন। সন্ধের দিকে তাঁরই বয়সি বেশ কয়েক জন ছেলে প্রায়ই তাঁকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় মাঠের ভিতর। তিনি তাঁদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। সেখানে তাঁর উপর চলতে থাকে শারীরিক অত্যাচার। এখানেই শেষ নয়। এই তরুণই যখন প্রত্যেক দিন সকালে দোকানে যান, বিকেলে বাড়ি ফেরেন, তাঁকে প্রভূত ব্যঙ্গ-তামাশার শিকার হতে হয়। সেই ছেলেরাই অপমান করে, যারা সন্ধের পর জোরজবরদস্তি করে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে মাঠের দিকে নিয়ে যায়। এই তরুণ কাকে গিয়ে বলবেন এই অত্যাচারের কথা? তাঁর যৌন-পরিচয় এ দেশে আইনত স্বীকৃত হলেও মানুষের মনে তার ধারণা আজও সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। আর যার অস্তিত্বই স্পষ্ট নয়, তার সম্মানহানির ঘটনা ক’জন মানুষ মেনে নেবেন, শুনতে চাইবেন?

অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাশে থাকার চেষ্টা করেন। কিছু অসরকারি সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বৃহত্তর দৃষ্টিতে তাকালে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী ক’জন ভিন্ন স্রোতের মানুষ সেই সাহায্যের হাতটুকু ধরে উঠতে সক্ষম? কেউ সমকামিতাকে সমর্থন করেন কি না, সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন ব্যক্তি-অধিকারের, ব্যক্তি-স্বাধীনতার। কারণ, দেশের গণতন্ত্রে কেউই কারও করুণার পাত্র নয়। উপেক্ষার চাদর সরিয়ে এই সরল সত্যটুকু আমরা কবে বুঝতে পারব?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন