Mimi Chakraborty

Mimi Chakraborty: রণবীরের ছবি কোন আইন ভাঙল? কারই বা ক্ষতি করল?

রণবীর সিংহের নগ্ন ছবি দেখে প্রথমেই প্রশ্ন তুলেছিলেন সাংসদ-অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। তার পর ঘটনা গড়িয়েছে বহু দূর। এখন কী লিখছেন তিনি?

Advertisement

মিমি চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২২ ১৪:৩১
Share:

রণবীরের বিতর্কিত সেই ছবি নিয়ে মিমির মতামত।

আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এই লেখা লিখতে বসে প্রথমেই বলি, আমি রণবীর সিংহের ভক্ত। ওঁর কাজ খুব পছন্দ করি। কারণ, রণবীর সব কাজই করেন নিষ্ঠার সঙ্গে। দেখেই বোঝা যায়, বেশ দরদ দিয়ে কাজটা করছেন। আবারও বলছি, ওঁর বিতর্কিত ওই ছবিতে যে চেহারা দেখা গিয়েছে, তা রীতিমতো প্রশংসা দাবি করে। ও রকম চেহারা বানাতে কতটা খাটতে হয়, তা জানি। কোনও পোশাকের আড়াল ছাড়া এ ভাবে নিজের শরীর দেখানোর জন্য আত্মবিশ্বাস চাই। তার জন্য তেমন চেহারা বানাতে হয়, তা আসে কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে। একই পেশায় থাকার কারণে জানি, অভিনেতাদের কতটা সময় ও শ্রম থাকে এর পিছনে। নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হয়। কার্বোহাইড্রেট বাদ দিতে হয় রোজের খাবার থেকে। মাঝেমধ্যে তো জলও খাওয়া যায় না। তাই সবার আগে সেই পরিশ্রমের তারিফ করা জরুরি। সেটা আমি আবারও করছি।

Advertisement

এর আগেও অভিনেতারা এমন শ্যুট করেছেন। রণবীর প্রথম নন। এখনও বিশ্বাস রাখি, আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক। নাগরিকদের নিজের পছন্দমতো কাজ করার অধিকার আছে। অভিনেতা তো অভিনয়ই করবেন। সেটাই তাঁর পেশা। কাল যদি কেউ ডাকাতের ভূমিকায় অভিনয় করেন, তার মানে তো তিনি ডাকাত হয়ে যাবেন না! অভিনেতারা যা-ই কাজ করুন, তার পিছনে একটা চিত্রনাট্য থাকে। অর্থাৎ, কিছু একটা দেখাতে চাওয়া হচ্ছে তাঁর সেই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। সেটাই ভাল ভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন অভিনেতারা। অভিনেতার নিজস্ব সত্তা আছে। তাঁর নিজস্বতা থাকারই কথা। ফলে তিনি কী ভাবে, কী কাজ করবেন, তা তাঁর উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। তা নিয়ে এত প্রতিবাদ, থানা-পুলিশ কেন হবে!

আমাদের দেশে এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আছে, যা নিয়ে পুলিশে অভিযোগ করা যেতে পারে। সাধারণ মানুষের রোজের জীবনে অসুবিধা হওয়ার মতো কত কী ঘটছে এখন। রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ছে, দৈনন্দিন ব্যবহার্য আরও কত কিছুর মূল্যবৃদ্ধি হয়েই চলেছে। এ নিয়ে তো প্রতিবাদ প্রয়োজন! তা না করে রণবীরের একটা ছবি নিয়ে এত হইচইয়ের কি আদৌ কোনও মানে আছে?

Advertisement

আরও একটা প্রশ্ন না করে পারছি না। এফআইআর তো দায়ের করেন এমন কেউ, যাঁর সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। বা যাঁকে আঘাত করা হয়েছে। রণবীরের নগ্ন ছবি কার, কোন ক্ষতি করেছে? কে, কী ভাবে আহত হলেন? তা তো এখনও বুঝতেই পারছি না! অনেকে ভাবেন, আমাদের মতো অভিনেতাদের আর এ সবে কী এসে যায়? অভিনেতাদের জীবন তো সোনায় মোড়া, রুপোর থালায় সাজানো। তা কিন্তু ঠিক নয়। ইনস্টাগ্রাম তো সব নয়। তার বাইরে প্রত্যেকের জীবন আছে। বাস্তব মোটেই সব ক্ষেত্রে ততটা ঝকঝকে নয়। আমরা কিন্তু ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমেও রোজগার করি। নিজেদের ছবি দেখিয়ে বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন করি। এ তো আমাদের কাজ। যেমন রণবীরের এই ছবিও তোলা হয়েছে একটি পত্রিকার জন্য। ওই ছবিটা তো তাঁর কাজ। ওই পত্রিকার জন্য আগেও বড় বড় অভিনেতারা কাজ করেছেন। যে কোনও মানুষের কাজের জন্য সম্মানই প্রাপ্য হওয়া উচিত।

রণবীর শিল্পী। এই ছবি শিল্প। একে শিল্প হিসাবেই দেখা দরকার। আমরা যদি প্রাচীন ভারতের গুহাচিত্র দেখি, সেগুলোকে কি অশালীন বলব? সেখানেও তো নগ্নতার প্রদর্শন আছে। সে সব ভাস্কর্য, ছবি তো আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। ওই শিল্পের বিরুদ্ধে কি পুলিশে অভিযোগ জানাব? তা হলে হঠাৎ রণবীরের কাজ অশালীন বলে দেগে দেব কেন?

ভারতের প্রাচীন সব গুহাচিত্র দেখে যদি মনে হয় অশ্লীল, তবে সেখানে না গেলেই হয়! ঠিক তেমন, ভাল না লাগলে, রণবীরের ছবি না দেখলেই হয়। রণবীরের ওই ছবি তো কারও কোনও ক্ষতি করতে আসছে না। যত ক্ষণ না সরাসরি কোনও কিছু থেকে ক্ষতি হচ্ছে, তত ক্ষণ তা নিয়ে এত মাতামাতি করার দরকার কী? প্রত্যেকের ভাল লাগা, মন্দ লাগার অধিকার আছে। কেউ নিজের পছন্দে কোনও কাজ করবেন। অন্যের তা পছন্দ না হলে দেখবেন না। এতেই তো মিটে যেতে পারে বিষয়টি।

দীপিকা পাড়ুকোনের ‘পদ্মাবত’ নিয়েও তো কত কাণ্ড হয়েছিল। ওঁর নামে পুলিশে অভিযোগ হয়েছে। লোকে আত্মহত্যাও করেছিল। তাতে কি দীপিকার কোনও ক্ষতি হয়েছে? তিনি নিজের কাজটা করেছেন। সেটা তো দীপিকার জীবনের সবচেয়ে সফল ছবির মধ্যে একটি। ফলে সকলকে বুঝতে হবে, রণবীরের নামে এফআইআর করে, তাঁর নিন্দা করে এলে কিছু হবে না। রণবীর নিজের কাজ করেছেন। আবার করবেন। যত ক্ষণ না তিনি আইন ভাঙছেন, তত ক্ষণ এ নিয়ে কিছু বলার থাকে না। আর আমি যত দূর জানি, এ দেশের সংবিধানে এমন কোনও আইন নেই, যা রণবীরের এই ছবি ভেঙেছে।

রণবীরের নগ্ন ছবি দেখার পরে আমিও প্রশ্ন তুলেছিলাম। তা রণবীরের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। মহিলা হিসাবে, মহিলাদের জন্য তুলেছিলাম। আমাদের তো সব সময়ে ‘পণ্য’ হিসাবে দেখা হয়। আমি যখন প্রথম সংসদে যাই, জিন্‌স আর টি-শার্ট পরে গিয়েছিলাম। তা নিয়ে কত হইচই! সংসব ভবনে এমন পোশাক নাকি পরা যাবে না। আমার নিন্দা তো কম হয়নি। আমার বক্তব্য তা নিয়েই ছিল। একুশ শতকে যখন নারীশক্তি নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে, তখন কী ভাবে এক জন পুরুষের সব কাজ মেনে নেওয়া হতে পারে আর এক মহিলা করলে মেনে নেওয়া হয় না, এটাই জানতে চেয়েছি।

সে প্রশ্ন আমার এখনও রয়েছে। এবং আমি মনে করি, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকলের নিজের পছন্দমতো কাজ করা, পোশাক পরার অধিকার রয়েছে। তার জন্য আমাকেও ‘ট্রোল’ করা যায় না, রণবীরকেও নয়। এখন তো আবার ‘ট্রোল’-এরও এক কাঠি উপরে চলে গিয়েছে। কথায় কথায় এফআইআর! কিন্তু অভিনেতা তো অভিনয় করবেন। বিভিন্ন চরিত্রে। এখন যদি রাস্তার ধারে জামাকাপড় ছাড়া বসে-থাকা কোনও মানসিক ভারসাম্যহীনের চরিত্রে অভিনয় করেন রণবীর, তখনও কি তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হবে? যদি হয়, তা হলেই বা যুক্তি কী? আর যদি না হয়, তবে এখন হচ্ছে কেন? কথায় কথায় লোকে বলছেন ভারতীয় সংস্কৃতিকে আঘাত করা হচ্ছে। প্রাচীন সব মন্দিরের গায়ে নগ্ন মূর্তি থাকে, সে সব ভাস্কর্য কি তবে ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ নয়? এক সময়ে তো পোশাক পরারই চল ছিল না। তার পরে এল গয়না। অনেক পরে সিল্ক বা অন্য কাপড়। মানুষ সে ভাবেই রপ্ত করেছে। তবে কি সে সব সভ্যতার অঙ্গ নয়? ফলে সবটাই নির্ভর করছে দৃষ্টিভঙ্গির উপর। কী ভাবে কী দেখছি, তা বোঝা দরকার।

ভারত স্বাধীন দেশ। গণতান্ত্রিক। সেখানে প্রত্যেকের অভিমত গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কারও আমার কাজ পছন্দ না হতে পারে। তিনি তা প্রকাশ করতে পারেন। আবার আমিও স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমারও নিজের মত, নিজের পছন্দ থাকবে। তাকেও সম্মান করতে হবে। রণবীরের ক্ষেত্রেও আমার মত এটাই।

এখন তো মতামত দেওয়া খুব সহজ। নেটমাধ্যমে যেখান-সেখান থেকে উড়ে আসবে মন্তব্য। দেশের কনিষ্ঠতম সাংসদদের মধ্যে আমি এক জন। অভিনেত্রী হিসাবেও আমার কাজ শেষ হয়নি। এখনও মধ্যগগনেই আছি বলা চলে। ফলে আমি কী পোশাক পরছি, শরীরের কোনও অংশ দেখা যাচ্ছে কি না, দেখা গেলে কোন অংশ দেখা যাচ্ছে— সবই ভাবতে হয় আমাকে। একটু এ দিক থেকে ও দিক হলেই হল! আমি তো বটেই, আমার বাবা-মা, পরিবারের সকলকে টেনে এনে চলবে হুলস্থুল চলবে। তখন কাজ করাই মুশকিল হয়ে ওঠে। সারা ক্ষণ মাথায় ঘুরবে। আমার মতো নিশ্চয়ই অন্যদেরও হয়। তাই মনে হয় এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত।

আমার মনে আছে, করিনা কপূর খানকেও এক বার এমন সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ‘কুরবান’ ছবির একটি পোস্টার বেরিয়েছিল। সেফ আলি খান আর করিনা ছিলেন। অভিনেত্রীর পিছন দিক থেকে ছবি তোলা হয়েছিল। তাঁর গায়ে কোনও পোশাক ছিল না। আমার তখন খুবই কম বয়স। মনে আছে, তখনও করিনার বাড়ির সামনে লোকজন জড়ো হয়ে গিয়েছিল। ওঁকে জামাকাপড় দান করার কথা বলেছিল। মহিলাদের কাজ নিয়ে এমন চলতেই থাকে। আমি যখন রণবীরের ছবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম, তখন সে প্রসঙ্গটাও তুলেছিলাম। আমি মনে করি, অভিনেতা-অভিনেত্রী সকলেই এক এক সময়ে এক একটি চরিত্রে কাজ করছেন। তাঁদের নিজেদের কাজ করার অধিকার আছে। এটুকু খেয়াল রাখা জরুরি।

(লেখক পেশায় অভিনেত্রী। যাদবপুর কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদ। মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন