চোখ-ধাঁধানো বিরাট প্রকল্প, বাইরের চাকচিক্যের দিকেই নজর
PM Narendra Modi

‘উজ্জ্বল ভারত’ এবং ভোট

বছর কুড়ি পরে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদীর মুখেও ইদানীং ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর কথা একটু অন্য ভাবে শোনা যাচ্ছে। তাঁর মুখে ‘ভারত চমক রহা হ্যায়’ বাক্য ঘুরেফিরে আসছে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৩ ০৫:২২
Share:

নয়নাভিরাম: নতুন সংসদ ভবন, দিল্লি, ২৭ মে। ছবি: পিটিআই।

২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ হেরে যাওয়ার পরে অরুণ জেটলি বলেছিলেন, অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারের পক্ষে হাওয়া ছিল। তাকে ছাপিয়ে আঞ্চলিক সমস্যা, জাতপাতের সমীকরণ বড় হয়ে উঠেছিল। বিজেপি নেতারা কোনও দিনই সরাসরি স্বীকার করতে চাননি, বিজেপি সেই নির্বাচনে শুধুমাত্র বাজপেয়ী সরকারের কাজকে পুঁজি করে নির্বাচনে লড়াইয়ের চেষ্টা করেছিল। এবং হেরে গিয়েছিল। ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ প্রচারমন্ত্র নিয়ে ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’-কে হাতিয়ার করতে চেয়েছিল। কিন্তু ‘চমকতা ভারত’-এর গল্প দেশের আমজনতা বিশ্বাস করেননি।

Advertisement

আবার বছর কুড়ি পরে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদীর মুখেও ইদানীং ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর কথা একটু অন্য ভাবে শোনা যাচ্ছে। তাঁর মুখে ‘ভারত চমক রহা হ্যায়’ বাক্য ঘুরেফিরে আসছে। এ বছরের গোড়ায় পড়ুয়াদের সঙ্গে ‘পরীক্ষা পে চর্চা’-তে তিনি বলেছিলেন, গোটা দুনিয়ায় মানচিত্রে ভারত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী ভারতের অর্থনীতি উজ্জ্বল আলোর মতো জ্যোতি ছড়াচ্ছে বলে দাবি করেছেন। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানেও তিনি বলেছেন, ওই ভবন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল উদাহরণ।

নরেন্দ্র মোদীর সমালোচকরা বলেন, তাঁর নজর বরাবরই চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার দিকে থাকে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই তিনি চোখ-ধাঁধানো বিরাট মাপের প্রকল্প, বাইরের চাকচিক্যের দিকে নজর দেন। সে সময় ‘গুজরাত মডেল’-এর প্রচারের আড়াল থেকে মানব উন্নয়নের সূচকে পিছিয়ে থাকা গুজরাতের ছবি বেরিয়ে পড়ত। এখনও তেমনই প্রধানমন্ত্রীর বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন ও বন্দে ভারত ট্রেন নিয়ে ঢক্কানিনাদের মাঝে রেলের সুরক্ষা-ব্যবস্থায় অভাব, রেল লাইনের রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি ফুটে উঠছে। তারই পরিণতি ওড়িশার ভয়াবহ রেল-দুর্ঘটনা।

Advertisement

বিরোধীরা আশা করতেই পারেন, ২০০৪-এ ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর প্রচার করেও যেমন বিজেপিকে হার মানতে হয়েছিল, ২০২৪-এ তেমনই মোদীর ‘উজ্জ্বল ভারত’-এর প্রচারকে হার মানতে হবে। এই আশা কতখানি বাস্তবসম্মত?

এতে কোনও ভুল নেই যে, নরেন্দ্র মোদী চোখ ধাঁধিয়ে দিতে ভালবাসেন। তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের গোড়াতেই গুজরাতের দাঙ্গার জেরে প্রায় এক দশক আমেরিকা-ইউরোপের দরজা নরেন্দ্র মোদীর জন্য বন্ধ ছিল। সে সময় তিনি বেশ কয়েক বার চিন সফরে গিয়েছিলেন। বিরাট মাপের প্রকল্প খাড়া করে চমকে দেওয়ার পাঠ সম্ভবত সেখানেই। ছ’বছর আগে তিনি সবরমতীতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজ়ো আবে-কে পাশে নিয়ে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, এত খরচসাপেক্ষ বুলেট ট্রেনের কী প্রয়োজন? ২০১৭’র হিসাবেই আমদাবাদ-মুম্বই বুলেট ট্রেন প্রকল্পের আনুমানিক খরচ ছিল ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ২১৭ কোটি টাকা ব্যয়। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বুলেট ট্রেন চালু করে দেশের মানুষকে চমক দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে ২০২৬-এর আগে তা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী এখন নিয়মিত অনেকটা বুলেট ট্রেনের ধাঁচে তৈরি বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধন করছেন। তাতে সাধারণ যাত্রীর বিশেষ সুবিধা হচ্ছে বলা যায় না। কারণ, রেলের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২-২৩’এ ২ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ টিকিট কেটেও ট্রেনে সংরক্ষিত আসন পাননি।

তা হলে আমজনতা কী পেল? ২০০৪-এ বিজেপির ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ স্লোগানের সামনে ঠিক এই প্রশ্নটাই তুলেছিল কংগ্রেস। এখনও কংগ্রেস-সহ বিরোধী শিবির প্রশ্ন তুলছে, মোদীর উজ্জ্বল ভারতে চাকরি কোথায়? তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব মাথাচাড়া দিয়েছে বলে বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট। গ্রামের অর্থনীতিতে এখনও করুণ ছবি। একশো দিনের কাজের চাহিদা আকাশছোঁয়া। মোদী সরকারের ন’বছরে খেতমজুর, গ্রামের মজুর, নির্মাণ-কর্মীদের বেতন এক শতাংশও বাড়েনি। অথচ মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। মোদী জমানায় শুধু আদানি গোষ্ঠীর সম্পত্তিই ফুলেফেঁপে উঠেছে। এত প্রশ্নের মুখে নরেন্দ্র মোদীর উজ্জ্বল ভারতের দাবি কি ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর মতোই হার মানবে?

এ দেশের মানুষ কোনও একটি বিষয় দেখে ভোট দেন না। প্রার্থী, জাতপাত, ধর্ম, খয়রাতি, দুর্নীতি, স্থানীয় সমস্যা, অনেক কিছুর উপরে তা নির্ভর করে। কোনও একটি বিষয়ে সাফল্য বা ব্যর্থতা ভোটের ফল ঠিক করে দেয় না। কিন্তু জাতীয় স্তরে কোনও একটি বিষয়ে গোটা দেশের আবেগ উস্কে দিতে পারলে বা কোনও ধারণা তৈরি করতে পারলে তাতে রুটিরুজি-সহ সব প্রশ্ন ঢাকা পড়ে যায়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে নোট বাতিলের সময় আমজনতার হেনস্থার অভিযোগ ছিল। নোট বাতিলের পরে বেকারত্ব চরমে ওঠার অভিযোগও ছিল। সব কিছু ছাপিয়ে পুলওয়ামায় সিআরপি কনভয়ে জঙ্গি হামলার জবাবে বালাকোটে বায়ুসেনার হানা নিয়ে মানুষের আবেগ নরেন্দ্র মোদীর প্রধান পুঁজি হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে দক্ষিণ ভারত বাদ দিয়ে দেশের বাকি অংশে হিন্দুত্ববাদী ভোটব্যাঙ্ককে এককাট্টা করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ। জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্বের আবেগে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা না মেলা, বছরে ২ কোটি চাকরি না হওয়া, অচ্ছে দিন-এর স্বপ্নভঙ্গের কথাও আমজনতার চেতনা থেকে মুছে গিয়েছিল। ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ঠিক এখানেই পিছিয়ে ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। সুশাসনকেই তিনি একমাত্র অস্ত্র করে ভোটে গিয়েছিলেন। দেশ জুড়ে কোনও আবেগ তৈরি করতে পারেননি।

ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ নরেন্দ্র মোদী জানেন, ২০১৯ ও ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন এক নয়। ২০২৪-এর লোকসভা ভোট যথেষ্ট বড় চ্যালেঞ্জ। দশ বছর সরকারে থাকলে স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের মনে অভাব-অভিযোগ তৈরি হবে। বার বার ভোটের আগে বালাকোটে বায়ুসেনার হানাকে ঘিরে আবেগ তৈরি করা যাবে না। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে রামমন্দির উদ্বোধন হলেও তা নিয়ে কতটা হিন্দুত্বের ঢেউ তোলা যাবে, সংশয় রয়েছে। কোভিড ঠেকাতে আচমকা লকডাউনের ধাক্কায় পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার স্মৃতি বিরোধীরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। শিল্পপতি গৌতম আদানির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সরকারি অবহেলার ফলে ওড়িশার রেল-দুর্ঘটনা নিয়েও অভিযোগের আঙুল উঠবে। বিরোধীরা বলছেন এবং বলবেন, মোদী সরকার শুধু মুষ্টিমেয় শিল্পপতি ও বড়লোকদের কথা ভাবে। সর্বোপরি কর্নাটকে কংগ্রেসের জয় থেকে শিক্ষা নিয়ে বিরোধী শিবির আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে ভোটে লড়াইয়ের চেষ্টা করবে। নরেন্দ্র মোদীর বদলে বিরোধী শিবির রাজ্য স্তরে বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে চাইবে।

এত দিন নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা ও উগ্র হিন্দুত্বের দাপটে বিজেপি যাবতীয় বাধা টপকে গিয়েছে। আচমকা লকডাউনের পরে পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে গ্রামে ফেরা, অক্সিজেনের অভাবে কোভিডে মৃত্যু, গঙ্গায় ভাসমান শব, দিল্লির সীমানায় কৃষকদের এক বছর আন্দোলন কোনও কিছুই উত্তরপ্রদেশ বা অন্যান্য রাজ্যের নির্বাচনে ছাপ ফেলেনি। কিন্তু এখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘই বিপদবার্তা শোনাচ্ছে।আরএসএস-এর মুখপত্র অর্গানাইজ়ার-এ কর্নাটকের হারের পরে বিজেপিকে আত্মসমীক্ষা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। আরএসএস মনে করছে, নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা ও হিন্দুত্বের নামে ভোটব্যাঙ্ককে এককাট্টা করা যথেষ্ট নয়। রাজ্য স্তরে মজবুত নেতৃত্ব ও কাজের সাফল্য জরুরি। রাজ্য স্তরে বিজেপি সরকার ভাল কাজ করে দেখাতে পারলেই জাতীয় স্তরে মোদীর নেতৃত্ব, মতাদর্শ বিজেপির সম্পদ হয়ে উঠবে।

এ যেন উলটপুরাণ! গত ন’বছরে বিজেপি-আরএসএস পুরোপুরি মোদী-নির্ভর হয়ে পড়েছিল। এখন আরএসএস-ই বলছে, শুধু ‘মোদী ম্যাজিক’-এ আর কাজ হবে না! মোদী কি আরএসএস-কে ভুল প্রমাণ করতে পারবেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন